অকালে চলে যাওয়া উত্তরবঙ্গের খ্যাতিমান কৃষকনেতা অধ্যাপক কমরেড বদিউজ্জামান বাদলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ৬ অক্টোবর। আকস্মিক হৃদরোগে ২০২১ সালে তিনি মারা যান। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির জেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (বাকবিশিস) জেলা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।দিনাজপুরে বসবাসরত রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদেরসংগঠন Rajshahi University Students’ Association Dinajpur (RUSAD) এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁর উদ্যোগেই রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে নিয়ে গড়ে ওঠে ‘রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় সাবেক শিক্ষার্থী ফোরাম’, যা বর্তমানে রুসাদ নামে পরিচিত।
বদিউজ্জামান বাদলের জন্ম১৯৬৭ সালের ২৪ অক্টোবর দিনাজপুর সদর উপজেলার যুগীবাড়ী গ্রামে। চেরাডাঙ্গীর ঐতিহাসিক মেলার মাঠের খুব কাছেই তাঁর বাড়ি। চেরাডাঙ্গী স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও কেবিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি।রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন বাদল। আমৃত্যু এই পেশাতেই ছিলেন তিনি।শিক্ষকতা করেছেন দিনাজপুর সঙ্গীত কলেজের মার্কেটিং বিভাগে। তিনি যে কতটা জনপ্রিয় শিক্ষক এবং সহকর্মী ছিলেন, তা বোঝা গিয়েছিলো তাঁর জানাজায় সহকর্মী আর শিক্ষার্থীদেরবুকফাটা কান্না দেখে।
তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে বদিউজ্জামান বাদল ছিলেন দ্বিতীয়, ভাইদের মাঝে জ্যেষ্ঠ। আত্মীয়দের মধ্যে তাঁর পরিচিতি আর জনপ্রিয়তা ছিলো অনেক বেশি। সবার সাথে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। কারও কোনো প্রয়োজন বা সমস্যার কথা জানামাত্রই ছুটে যেতেন তার পাশে। পুরো জেলাজুড়েই পরিচিত মানুষ ছিলো তাঁর।পাশ করেযাওয়া শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখতেন সবসময়। কে কোথায় আছে, কী করছে- তার জানা থাকতো তাঁর।
আজীবন বামপন্থী রাজনীতির একনিষ্ঠ সেবক কমরেড বাদল কলেজজীবনে যুক্ত হন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাথে।১৯৯২ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নামে একীভূত দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। কমরেড বাদল এই একীভূত পার্টিরসাথে যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি পার্টির সাংস্কৃতিক গণসংগঠন বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা ও যুব গণসংগঠন বাংলাদেশ যুবমৈত্রীর জেলা কমিটিতেও ছিলেন। সবসময় অত্যন্ত সক্রিয় ও পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন তিনি।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধতার প্রশ্নে পার্টিতে দ্বিমত দেখা দেয়।আওয়ামী লীগের সাথে না গিয়ে বিকল্প শক্তি হিসেবে বামপন্থীদের স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ার পক্ষে ছিলেন দলের একটি অংশ।রণনীতি-রণকৌশলের দ্বান্দ্বিক বিতর্কে ভেঙ্গে যায়বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত) যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালে। পরবর্তীতে এই অংশটি যোগ দেয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে। কমরেড বদিউজ্জামান বাদল এই দলের দিনাজপুর জেলা কমিটিতে যুক্ত হন। দায়িত্ব পান বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন জেলা কমিটির আহবায়কের।পরে পার্টির সিদ্ধান্তে কাজ শুরু করেন কৃষক সংগঠনে।২০১৩ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব পান বাংলাদেশ কৃষক সমিতি দিনাজপুর জেলা সভাপতি, আর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে কমিউনিস্ট পার্টি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।বিভিন্ন গ্রামে-বাজারে-হাটে ঘুরে ঘুরে সংগঠিত করেন কৃষকদের। পাশাপাশি আদিবাসীদের নিয়ে আদিবাসী ইউনিয়ন গড়ে তোলার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। একাধিক আদিবাসী গ্রামে-পাড়ায় ঘুরেছেন, সংগঠন গুছিয়েছেন। দিনাজপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি প্রতিষ্ঠার পর গ্রাহক হয়রানী বন্ধের দাবিতে৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছিলো বাংলাদেশ কৃষক সমিতি দিনাজপুর জেলা কমিটি। ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল এই কর্মসূচির মূল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন কমরেড বাদল। ধানের লাভজনক মূল্য, আলু-টমেটো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ, ধানের বস্তায় অতিরিক্ত ওজন দেখিয়ে (স্থানীয় ভাষায় যা ধলতা নামে পরিচিত)কম টাকা দেওয়া, সদরউপজেলার উত্তর গোসাইপুরে চালকলের কারণে ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষণ, ২০১৭ সালের বন্যার পর বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন- প্রভৃতি ইস্যুতে একের পর এক সফল আন্দোলন রচনা করেন তিনি। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম কাতারের সাহসী যোদ্ধা ছিলেন বদিউজ্জামান বাদল।
২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল দিনাজপুরের গোপালগঞ্জ হাটের অদূরেযমুনা অটো রাইস মিলে ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণে ১৮ জন শ্রমিক নিহত হন। দিনাজপুর তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো চালকলের বয়লার বিস্ফোরণে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা এটি।এই মর্মান্তিক ঘটনার পরপরই যমুনা অটো রাইসমিলে ছুটে গিয়েছিলেন কমরেড বাদল। হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাওয়া, প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিলো।
শিক্ষকনেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক ও তৎপর। বাকবিশিস এর ব্যানারে দীর্ঘদিন ধওে আন্দোলন হয়েছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরশিক্ষক-কর্মচারিদের বৈশাখী ভাতা ও বার্ষিক ৫শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবিতে। অত্যন্ত যৌক্তিক এ দাবিতে শিক্ষকদের নিয়ে রাজপথে সবসময় সক্রিয় ছিলেন অধ্যাপক বাদল। শিক্ষার জাতীয়করণেরদাবিটি তিনিবারবারই সামনেএনেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূলপরিবর্তন করতে হলেতা জাতীয়করণের মাধ্যমেই শুরু করতে হবে,আরএইবিষয়টি এ কারণেই বারংবার সর্বত্র তুলেধরতে চাইতেন তিনি। বৈশাখী ভাতাসহ বেশকিছু দাবি পূরণ করেছে সরকার, দুঃখজনক ঘটনা হলো, সেই দাবি আদায়ের সংগ্রামী কুশীলবদের অন্যতম অধ্যাপক বদিউজ্জামান বাদল নিজেই তার সুফল নিজের জীবনে পেলেন না।
সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিকদেরএসব সমস্যা-সংকট নিয়ে আন্দোলন-সংগঠন গড়ে তোলার কাজটি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলো অনবদ্য এক অবস্থানে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমরেড বাদল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কাস্তে প্রতিকে দিনাজপুর-৩ আসনেপ্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বিভিন্ন কারণে এই নির্বাচনটি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছেই ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। তথাপি কমরেড বাদল ৫১৫৩ ভোট পান। তরুণ ভোটারদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। দিনাজপুর শহরের অনেক তরুণ তাঁর পক্ষে কাজ করেছেন, ভোট দিয়েছেন- যদিও রাজনৈতিক পরিচয়ে তাঁরা সিপিবির কর্মীছিলেন না। ‘বাদল ভাই ভালো মানুষ, আর কমিউনিস্ট পার্টি ভালো মানুষের দল’- এটাই ছিলো তাদেরযুক্তি। চাঁদগঞ্জ বাজার কেন্দ্রে তাঁরজন্য প্রচারণার কাজ করেছিলেন যমুনাঅটো রাইসমিলেরআহত শ্রমিক, যার নামও বাদল। তিনি নিজে থেকেইএই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন।
বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারী ছোবল হানে ২০২০ সালে। বাংলাদেশেও তার সর্বগ্রাসী রূপ হানা দেয়। বাংলাদেশ সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছিলো।গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোএসময় পড়েছিলো চরম বিপাকে। কাজ নেই। আয় নেই। বাড়ির চুলা জ¦লেনা। কিন্তু পেটের ক্ষুধাতো আর সেসব যুক্তি মানেনা।এই কঠিনসময়ে কমরেড বাদল তাঁরদলেরপক্ষ থেকে বিভিন্নএলাকায়অভাবী মানুষেরমাঝে খাবার, টাকা ওওষুধ বিতরণেরব্যবস্থা করেছেন।বিভিন্ন জায়গা থেকে ও পরিচিত স্বচ্ছল বন্ধু-আত্মীয়-শুভানুধ্যায়ীদেরকাছ থেকেএসব অর্থসংগ্রহ করেছিলেন তিনি। নিজের টাকার পেট্রোলপুড়িয়ে ঘুরে ঘুরে তিনি সাহায্য তুলেছেন, পার্টি গড়েছেন- কিন্তু কখনো আলাদাভাবে সেই পেট্রোলের টাকা নেননি সেই তহবিল থেকে।
বদিউজ্জামান বাদল কৃষকনেতা ছিলেন। উত্তরবঙ্গেরকৃষি ও কৃষক নিয়ে তাঁর বিভিন্নমুখী ভাবনা ছিলো। এই অঞ্চলের টমেটোচাষীদেরনিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। টমেটো সংরক্ষণের বিশেষায়িত হিমাগার না থাকায় দিনাজপুর জেলায় টমেটোর লাভজনক দাম থেকে চাষীরা বঞ্চিত হন, এই বিষয়টি তাঁকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিলো। পৃথিবীতে টমেটো উৎপাদনকারি দেশের সংখ্যা ১৭৫টি, তারমধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩তম। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় দুই মিলিয়ন টনের কাছাকাছি পরিমাণ টমেটোরউৎপাদন হয়।২০১৯-২০ কৃষিবছরেদিনাজপুর জেলায় টমেটো চাষ করা হয়েছিলো ২৬৯৮ হেক্টর জমিতে। সেবছরএ জেলায় নাবি জাতের টমেটো আবাদ হয় ৫১ হাজার ৪৬৮ মেট্রিক টন, আর রবি জাতের টমেটো আবাদ হয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন। এত বিপুল পরিমাণ টমেটো একবারেসবসময় বিক্রি হয়না। আবার দুই সপ্তাহের বেশি এই ফসল ঘরে রাখাও যায়না, কারণ টমেটোদ্রুত পচনশীল। কমরেড বদিউজ্জামান বাদল সর্বপ্রথম এ দাবিটি নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। বিভিন্ন হাটে-বাজারে হাটসভা অনুষ্ঠিত হয়, সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যন্ত দাবিটি তুলে ধরা হয়েছে।দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গেরকৃষক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কমরেড বদিউজ্জামান বাদলের তুলে ধরা এই সমস্যা ও তার সমাধানকল্পে টমেটো সংরক্ষণের হিমাগার নির্মাণ করা এখন সময়ের দাবি। গাবুরা এলাকায় সেটি নির্মাণ করা যেতেপারে। টমেটোচাষীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা কৃষকনেতা বদিউজ্জামান বাদলের নামেই হিমাগারটির নামকরণ করা যেতে পারে।
লেখক : এস এম চন্দন: সাবেক সংগঠক, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, দিনাজপুর জেলা কমিটি।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোফাচ্ছিলুল মাজেদ
মাজেদা মনজিল, মালদাহপট্টি
দিনাজপুর-৫২২০
মোবাঃ ০১৭১৪৯১০৭৭৯, ০১৭৭২৯৩৩৬৮৮
ই-মেইলঃ dinajpurbarta2017@gmail.com, dinajpurbarta24@yahoo.com
দিনাজপুর বার্তা ২৪