মো. জোবায়ের আলী জুয়েল :-
গৌরবময় কালের সাক্ষী শতবর্ষে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। বর্তমান ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এটি ১১৬ বর্ষ পেরিয়ে এসেছে। দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের ইতিহাস বলতে গেলে অতীতের সেকালের বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট কিছুটা হলেও বর্ণনা করা দরকার।
সে সময় দিনাজপুর শহরে চিত্ত বিনোদনের মধ্যে যাত্রা, কথকতা, কবির গান, পাঁচালী, জাগের গান প্রভৃতি অনুষ্ঠানই জনগনের মনোরঞ্জন করতো। দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথের আমলে (১৮৬২-১৯১৩ খ্রি.) দিনাজপুর রাজবাড়ী ছিল সঙ্গীত ও লালিত কলার একটি আকর্ষণীয় কেন্দ্রস্থল। শারদীয় পুজার সময় তাঁর আমলে রাজবাড়ীতে বসতো “কালোয়াতী গানের আসর।” এই শারদীয় পুজা উপলক্ষে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গুণী কলাবীদদের সমাবেশ এবং মনোজ্ঞ সঙ্গীত সম্মেলন তখন একমাত্র দিনাজপুরের রাজবাড়ী ছাড়া বাংলার গ্রাম গঞ্জে খুব একটা বেশী অনুষ্ঠিত হতো বলে জানা যায়নি। তাছাড়া মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের “রামলীলা” উৎসব ছিল তখন দিনাজপুরের প্রধান চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। মাড়োয়ারীপট্টি একালায় রাম রাম মন্দির চত্বরে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরী করে “রামলীলা” অনুষ্ঠান মঞ্চস্থঃ হতো। মাড়োয়ারীগণ ছাড়াও অগণিত হিন্দু ভক্ত সম্প্রদায়ের প্রচুর আগ্রহী দর্শক “রামলীলা” অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো।
দিনাজপুরে একধিক বার বিখ্যাত চারণকবি ও পালাগানের রূপকার বরিশালের মুকুন্দ দাশ দিনাজপুর শহরে এসেছেন তার বিখ্যাত পালাগান ও যাত্রা নিয়ে। রাজবাড়ী প্রাঙ্গণে ও ডায়মন্ড জুবিলী মাঠে তিনি একাধিক বার বেশ সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত করেছেন তার যাত্রা ও পালাগান। দিনাজপুরের সৌখিন নাট্যমোদী ও সংস্কৃতি সেবীরা সারা রাত ধরে প্রাণ ভরে উপভোগ করতেন এসব যাত্রা ও পালাগান। দিনাজপুর শহরে কয়েক দিনের জন্য হৈ চৈ ও অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যেতো সর্ব্বত্তোই।
এই ধারাবাহিকতায় সে সময়ে দিনাজপুর শহরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিনোদন, প্রভৃতি শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অনেকগুলি সংস্থার উদ্ভব হতে দেখা যায়।
দিনাজপুরে প্রথম পত্রিকা ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আত্মপ্রকাশ করে। (স্বনামধন্য ব্রজেশ্বর সিংহ ছিলেন সম্পাদক ১৮৮৫ খ্রি,)। উল্লেখ করা যেতে পারে এ সময়ই দিনাজপুরে প্রথম ছাপাখানা “সেন প্রেসের” উদ্ভব হয় ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে। তারপূর্বে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম নাটক অভিনীত হয় রথের মাঠে। নাটকটির নাম ছিল “জয়দ্রথ”। চিত্ত বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বড় মাঠের মধ্যস্থলে সরকারী পর্যায়ে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকা ইমারত বিশিষ্ট নির্মিত হয় স্টেশন ক্লাব। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর শহরের উপকন্ঠে ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানীর সহযোগিতায় ক্ষেত্রীপাড়ায় নির্মিত হয় প্রথম থিয়েটার হল “ডায়মন্ড জুবিলী হল” (বর্তমানে লুপ্ত)। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পৃষ্ট পোষকতায় ছিলেন তৎকালীন দিনাজপুরের খ্যাতনামা তরুণ মঞ্চ ও নাট্য শিল্পী, ক্রীড়ামোদী “হরিচরন সেন” (মৃত্যু ১৯৩৩ খ্রি,)।
জেলার প্রথম মুসলিম নেতৃত্বের জনক ও বারের প্রথম ইংরেজী নবীশ মুসলমান আইনজীবি খান বাহাদুর একীন উদ্দিন আহম্মেদের চেষ্টায় (১৮৮৬ খ্রি. বারের ইংরেজী নবীশ দিনাজপুরের বি.এল উকীল) দিনাজপুর জেলাবাসী মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর “মুসলমান সভা” ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত করেন খান বাহাদুর একীন উদ্দীন (১৮৬২-১৯৩৩ খ্রি.)
১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে ঐ বৎসরই হরিচরণ সেন ও গণেশতলা নিবাসী বিখ্যাত জমিদার অতুল বড়াল ও স্থানীয় শিল্পমোদী, ক্রীড়ানুরাগীদের তত্ত¡বধানে জেল খানার সন্নিকটে “দিনাজপুর ইন্সটিটিউট” স্থাপিত হয়। স্থানীয় দিনাজপুর বাসীর খেলাধুলা, পড়াশুনা, শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এটি ছিল তখনকার আমলে শহরের প্রথম বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চ্চার প্রধান কেন্দ্রস্থল। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী কালের বিবর্তনে ক্লাবটি এখন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে টিকে রয়েছে। আগের সাবেক ভবনটি ভেঙ্গে সেখানে নির্মিত হয়েছে আধুনিক ডিজাইনের নতুন ভবন। দিনাজপুরের সুধী সমাজের নিকট এটি সাংস্কৃতিক চর্চ্চা ও স্থাপত্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন। কিন্তু ঐতিহ্যের ধারা বাহিকতায় পুরাতন ভবনটির ডিজাইন সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।
দিনাজপুরের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট স্থাপিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্লাবের কর্মকর্তাদের চেষ্টায় পরবর্তীতে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দিনাজপুরে স্থাপিত হয়ে ছিল “ডিষ্টিক্ট স্পোর্ট ক্লাব”। এটি পরবর্তীতে “টাউনক্লাবে” রূপান্তরিত হয়। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি দিনাজপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যেই খেলাধুলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চ্চার প্রাক যুগেই দিনাজপুর ইন্সটিটিউট এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে এবং সেকালে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট এক গৌরবময় স্বর্ণ যুগের পথিকৃৎ হিসাবে পরিগণিত হয়।
১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার পর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরবর্তীতে উপ-মহাদেশের অধিকাংশ শীর্ষ স্থানীয় নেতা হিন্দু - মুসলিম স্ব স্ব দলের বা সংগঠনের প্রচার উপলক্ষে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণকে সামনে রেখে দিনাজপুর শহরে পদার্পণ করেন এবং পরবর্তীতে গোলকুঠি মাঠ, ডায়মন্ড জুবিলী মাঠ, নাট্য সমিতি হল (১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত) কংগ্রেস মাঠ (একাডেমী স্কুল মাঠ), গোর-এ- শহীদ মাঠ, ঈদগাহ বস্তী মাঠ, বিরাট বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১৯০৬ খ্রি.) স্যার সুরেন্দ্রনাথ, মহাত্মাগান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, মৌলানা বদরোদ্দজা, ঈসমাইল হোসেন সিরাজী, আবুল কালাম আজাদ (মৌলনা, ভারতীয় কংগ্রেস নেতা) অধিকাংশ বরেণ্য নেতা, শিল্পী, দেশ প্রেমিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দিনাজপুরে আগমন করেছেন। তারা শংকর বন্ধোপাধ্যায়, ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরের শিল্পীদের দ্বারা তাঁর লিখিত নাটকের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে। নাটকটির নাম ছিল “দুই পুরুষ”। দিনাজপুরের বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা শিব প্রসাদ কর ছিলেন নাটকটি অভিনেতা ও পরিচালক। নাট্য সমিতিতে নাটকটি সাফল্যের সঙ্গে অভিনিত ও পরিচালনা করে তিনি সাহিত্যিক তারা শংকরের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। মফস্বল শহর দিনাজপুরের নাট্যমঞ্চে তাঁর উপন্যাসের এরূপ সার্থক নাটক মঞ্চায়ণ হতে পারে তিনি তা ধারণা করতে পারেন নাই। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন দিনাজপুর ডায়মন্ড জুবিলী হলে। কথা শিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দিনাজপুর বাসীর পক্ষ থেকে একটি নাগরিক সম্মর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। এতে দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দরা সে সময় সার্বিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে সর্ব্ব বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতা স্বনামধন্য আইনজীবী, দিনাজপুরের কৃতী সন্তান যোগীন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের জন্ম হয়, এর সভাপতি ছিলেন দিনাজপুর বারের স্বনামধন্য শ্রী মাধব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু)।
এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণের ধারাবাহিকতায় সে সময়ে ইতিহাসে অনেকগুলিন রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগের জন্ম। ১৯১৫-১৯১৬ খ্্িরষ্টাব্দের দিকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের দিনাজপুর জেলা শাখার রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানতে পারা যায়। ১৯৩২-১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জেলা শহরে কমুন্যিষ্ট পার্টির কর্মশিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দিনাজপুরের কালীতলা নিবাসী উকীল সুশীল সেন। তেভাগা আন্দোলনের মো. হাজী দানেশ, গুরুদাশ তালুকদার, বারোদা চক্রবর্তী, রূপনারায়ণ রায়, হেলে কেতু সিং, প্রমুখ বিপ্লব বাদী নেতাদের উদ্ভব হয় তখন থেকেই।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে যে, আন্দোলনের হয় তা দিনাজপুর কোন মৌখিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয় নাই। দিনাজপুরে সে সময় একটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং স্বদেশী জিনিসের কারবার করার জন্য দিনাজপুরে “ট্রেডিং এন্ড ব্যাংকিং কোম্পানী” নামক একটি যৌথ কারবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দুটি কার্য্যেই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন সে সময়ে দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের স্বনামধন্য সদস্য স্বগর্ত ললিত মোহন উকীল।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় নিবেদিত ক্রীড়া অনুশীলনের মাধ্যমে আনুমানিক বিশ দশকের দিকে দিনাজপুরে স্থাপিত হয় “ডিষ্ট্রিক্ট স্পোর্টিং ক্লাব”। এই ক্লাবের মাধ্যমেই পরবর্তীতেই শহরের বড় মাঠে ফুটবল খেলার প্রবর্তন হয় এবং ব্যাট মিন্টন খেলার ও প্রবর্তন হয়। এই ইন্সটিটিউট বিদেশী খেলার মধ্যে বিগত শতাব্দির প্রথম দিকে টেনিস খেলার প্রবর্তন হয় “স্টেশন ক্লাবে” (১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বড় মাঠে প্রতিষ্ঠিত)। প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত সিবিলিয়ান গণই টেনিস খেলার পৃষ্ট পোষকাতায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া সে আমলে রাজবাড়ীর সদর মহলের নিকট প্রাঙ্গণে সাহেবী খেলা টেনিস খেলার মাঠ ছিল। রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্য এই খেলার জন্মও হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়, টেনিস কোর্ট ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ (বর্তমানে এই টেনিস কোর্ট আর আগের মতো নেই)। এবং তখন থেকেই ইংরেজ রাজত্বের পরে পরেই ক্রমে ক্রমে এই খেলা দিনাজপুরবাসীর মধ্যে প্রসার লাভ করে। শোনা যায় ক্রিকেট খেলার ও সুত্রপাত হয় এখান থেকেই গত ত্রিশ দশকে। এছাড়াও বিদেশী খেলা পিংপং খেলার ও সুত্রপাত হয় এখান থেকেই গত তিরিশ দশকে। ত্রিশের দশকে এক সময় নাম করা টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন গনেশতলা নিবাসি বিশিষ্ট জমিদার সমাজ সেবী ও ইন্সটিটিউট ক্লাবের স্বনামধন্য সদস্য শ্রী অতুল বড়াল। তিনি নিয়মিত এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে টেনিস খেলায় অংশ নিতেন। এছাড়াও তৎকালীন এই ইন্সটিটিউট ক্লাবের অন্যতম সদস্য ছিলেন স্বনামধন্য নিশিকান্ত চৌধুরী ও শ্রী কমলা কান্ত রায়। এদের আমলেই পৃষ্ঠপোষকতায় দিনাজপুরের ফুটবল খেলার প্রতিযোগীতা শুরু হয় (হরিপুরের ক্রীড়া মোদী জমিদার নর নারায়ন রায় চৌধুরীর নামানুসারে ১০০ শত ভরি সোনা ও রূপার সম্বনয়ে)। এই টুনার্মেন্টে দিনাজপুরের বিখ্যাত খেলোয়াড়রা প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্যরা হলেন ফুলবল জাদুকর সামাদ, শামসুদ্দীন, হরিয়া, তসলীম, আব্দুস ওয়াহেদ খান, নেপা, মান্না মিয়া, জগদীশ কর, গুপিরঞ্জন প্রমুখ খেলোয়াড় বৃন্দ।
অতীতে যেমন ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গন দিনাজপুরের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছে বর্তমানে এসেও তাঁর ধারাবাহিকতা সমভাবে বিদ্যমান।
এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে ইতিহাসের বিখ্যাত চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন হত্যার ঘটনায় জ্বালাময়ী ও প্রতিবাদী বক্তব্য রাখেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা। এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ থেকে সোচ্চার হয়েছিল সারা বাংলাদেশে মেহনতি জনতার বলিষ্ট কন্ঠস্বর।
“নজরুল শত বার্ষিকী” উদযাপন উপলক্ষে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে “নজরুল জন্ম শত বার্ষিকী” ব্যাপক কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী তাদের অনুষ্ঠান পালন করেন এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে। দিনাজপুর পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্দেগ্যে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী “নজরুল মেলা”য় উদীচি শিল্পী গোষ্ঠী ব্যাপক ভূমিকা ও অবদান রাখেন। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে দিনাজপুরের সর্ব্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র নেত্রীবৃন্দ, শিক্ষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবি, আইনজীবি, বণিক সমিতি, ব্যবসায়ী নির্বিশেষে সমাজের সর্ব্ব স্তরের মানুষ ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তখন দিনাজপুর ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ। ছোটি ভাই ( মির্জা নুরুল হুদা), আসলে ভাই, তারা ভাই, দবিরুল ভাই, তোজা ভাই, মন্টু ভাই, নাসিম চৌধুরী, গোলাম রহমান, আজিজুল ইসলাম জগলু ভাই, কাজী বোরহান (নাট্য সমিতির অধ্যক্ষ), আমানুল্লাহ, দলিল উদ্দীন প্রমুখও বায়ান্নার ভাষা আন্দোলনে এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে সর্ব্বস্তরের জনগণকে ৫২এর ভাষা আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য সকলকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন। বন্যার ¯্রােতের মতো উর্দ্ধশ্বাসে চারিদিক থেকে এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে দুঃসাহস নিয়ে ছুটে এসেছিলেন আবাল বৃদ্ধ বণিতা মিটিং ও মিছিলে যোগদানের জন্য।
আমাদের গৌরবজ্জোল মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ৩১ মার্চ ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সাধারণ সমাবেশে দিনাজপুরে সর্ব্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা আহবান করেন। সভায় তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙ্গালী জাতীয়তা বোধে উদ্ধুদ্ধ হয়ে জনাব ইউসুফ আলী (বর্তমানে মরহুম), এডভোকেট গোলাম রহমান (বর্তমানে মরহুম), গুরুদাস তালুকদার (বর্তমানে প্রয়াত) প্রমূখ শীর্ষ স্থানীয় নেতারা জ্বালাময়ী ভাষণ দান করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এখান থেকেই মহান স্বাধীনতার ডাক দেয় জনগণ বর্ব্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। অতীত ইতিহাসের পেক্ষাপটে দিনাজপুর শহরের বুকে যাবতীয় উন্নয়ণমূলক কর্মকান্ড ও গঠনমূলক নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, কৃষি, ব্যবসা, চিকিৎসা বিভিন্ন আর্থ সামাজিক তৎপরতা এবং ক্রীড়া ও বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ বাঙ্গালীর সমাজে এক বিরাট ভূমিকা ও অবদান রেখেছে। বর্তমান এই গৌরবজ্জোল দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছে যথাক্রমে, জনাব রফিকুল ইসলাম এবং জনাব আব্দুস সামাদ।
দীপ্ত আলোর আজাদী সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল এই ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণ তার অতীত বর্তমান গৌরবজ্জোল একশত বছর অতিক্রান্ত করেছে (১৯০৪ খ্রি. - ২০০৪ খ্রি.)। বিগত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট বিজয়ের বেশে নদীর স্রোতের মতোই বহমান। দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন একশত ষোল বৎসরে উর্ত্তীণ হবে।লেখক: কলামিষ্ট, সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মো: জোবায়ের আলী জুয়েল
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোফাচ্ছিলুল মাজেদ
মাজেদা মনজিল, মালদাহপট্টি
দিনাজপুর-৫২২০
মোবাঃ ০১৭১৪৯১০৭৭৯, ০১৭৭২৯৩৩৬৮৮
ই-মেইলঃ [email protected], [email protected]
দিনাজপুর বার্তা ২৪