মোঃ আফছার আলী খান ॥ ঈদ বিশ্ব মুসলিম মননে এ অনন্য আনন্দ উৎসব হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে। হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়াইহি ওয়া সালস্নাম বলেছেন: সব জাতিরই আনন্দ-উৎসব আছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে ঈদ। ঈদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রথম ঈদ পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১ শাওয়াল মুতাবিক ৬২৪ খৃস্টাব্দের ৩১ মার্চ মদীনা মনওয়ারায়, আর মক্কা মুকাররমায় প্রথম ঈদ পালিত হয় ৮ম হিজরী মুতাবিক ৬৩০ খৃস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের প্রায় ১১ দিন পর। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের প্রচার শুরু হয় ৬৪০ খৃস্টাব্দ নাগাদ। বাংলাদেশে কোথায় যে ঈদের সালাত প্রথম কায়েম হয়েছিলো তা জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায় সন্দীপ অঞ্চলে প্রথম ঈদের জামাআত হয়েছিলো। ঢাকায় বোধকরি প্রথম ঈদ উদ্যাপিত হয় সুলতানী আমলে।
২৭ জানুয়ারি ১৯৭২, বৃহস্পতিবার। তখন স্বাধীন দেশ। মুক্ত বাঙালি জাতি। কোথাও নেই পাকিস্তানি হানাদারদের সেই আগ্রাসী ও বর্বর হায়েনারূপীদের পদচারণ। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদ উল আজহা (কোরবানির ঈদ) উদ্যাপন করেছিল বাঙালি জাতি।
ঈদের নামাজ (এছাড়াও সালাত আল-ঈদ (আরবি: صلاة العيد) এবং সালাত উল-ঈদায়ইন (আরবি: صلاة العيدين নামে পরিচিত) হচ্ছে একটি বিশেষ নামাজ, যা মুসলমানরা মূলত তাদের দুটি ধর্মীয় উৎসবের দিন আদায় করে। সাধারণত এটি বরাদ্দকৃত কোন খোলা জায়গা (মুসল্লা বা ঈদগাহ) অথবা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের যে দুটি উৎসবে বৃহৎ আকারে একত্রিত হয়ে এই নামাজ আদায় করা হয়, তা হলো:
ঈদুল ফিতর (আরবি: عيد الفطر), হিজরী সনের দশম মাস, শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে উদযাপন করা হয়।
ঈদুল আযহা (আরবি: عيد الأضحى), হজ্জ তীর্থযাত্রার প্রধান দিন আরাফাতের দিনের পরবর্তী দিন হিজরী সনের দ্বাদশ মাস, জ্বিলহজ্জ মাসের দশম দিনে উদযাপন করা হয়।
সব জাতিরই সুনির্দিষ্ট কিছু উৎসব রয়েছে। জাহেলি যুগেও আরবে নওরোজ ও মেহেরজান নামের দুটি উৎসব ছিল। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের এর চেয়ে উত্তম দুটি উৎসব উপহার দেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এক মাস সিয়াম সাধনার পর পয়লা শাওয়াল পালন করা হয় ঈদুল ফিতর। আর ১০ জিলহজ পালন করা হয় ঈদুল আজহা। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ হয়। একই হিজরিতে ঈদুল আজহার নামাজ ও কোরবানির বিধানও নাজিল হয়
নামকরণ
ঈদ শব্দটি আরবি। অর্থ খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠান, উৎসব, পর্ব ইত্যাদি। শব্দের মূল রূপ হলো আওদ, যার অর্থ ফিরে আসা। লিসানুল আরব অভিধানে রয়েছে, আরবদের কাছে ঈদ বলা হয় এমন সময়কে, যে সময় আনন্দ ও দুঃখ ফিরে আসে। আল মুহিত অভিধানে রয়েছে, যে রোগ, দুঃখ, দুশ্চিন্তা বা অনুরূপ কোনো কিছু বারবার ফিরে আসে তাকে ঈদ বলা হয়। আল মুনজিদ অভিধানে বলা হয়েছে, ঈদ এমন দিনকে বলা হয়, যাতে লোকজনের সমাগম হয় বা কোনো সম্মানিত ব্যক্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণা করা হয়। ঈদ প্রতিবছর সাজগোজ, আনন্দ-খুশি ও নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ফিরে আসে। এ কারণে ঈদের দিনকে আনন্দ ও খুশির দিন বলা হয়। অভিধানে বলা হয়েছে, ঈদকে এ জন্য ঈদ বলা হয় যে তা প্রতিবছর নতুন আনন্দ ও খুশি নিয়ে ফিরে আসে। কোরআন মজিদেও ঈদ শব্দের ব্যবহার রয়েছে; যেমন—মরিয়ম তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন, তা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্য হবে ঈদ-আনন্দোৎসব এবং আপনার পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১১৪)। এই আয়াতে আসমানি খাদ্য নাজিল হওয়ার দিনটি পরবর্তীদের জন্য স্মৃতিচারণার দিন হওয়ায় তাকে ঈদ বলা হয়েছে।
ঈদের প্রবর্তন
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর ঈদের প্রবর্তন হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান যে মদিনায় বসবাসকারী ইহুদিরা শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মেহেরজান উৎসব উদ্যাপন করছে। তারা এ উৎসবে নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন আনন্দ উৎসব করে থাকে। মহানবী (সা.) মুসলমানদের এ দুটি উৎসব পালন করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের ওই উৎসবের বিনিময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো পবিত্র দুটি দিন দান করেছেন। এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উৎসব পালন করো। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন তাদের দুটি দিন ছিল, যাতে তারা উৎসব পালন করত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এ দুটি কিসের দিন? তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগে এ দুই দিন খেলাধুলা ইত্যাদি উৎসব পালন করতাম। এ নিয়মই চলে আসছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দুটির পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১১৩৬; মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ১৩৬৪৭)
(১৩০০–১৫৩৮ খ্রি মোটামুটি দুইশত বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়। গৌড় পান্ডুয়া, সোনারগাঁওকেন্দ্রিক রাজধানী শহরগুলোতে তৎকালীন সুলতানদের নির্মিত মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। ঈদ উপলক্ষে সুলতান, আমীর, ওমরাহদের উদ্যোগে ঈদের বর্ণাঢ্য মিছিল হতো, এ মিছিলে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমাহার থাকত।
ইসলামী পতাকা, রঙ–বেরঙের পতাকা বহন করে চলত পাইকরা, মিছিলের অগ্রভাগে রাজকীয় হাতিতে অবস্থান করতেন সুলতান স্বয়ং। ছাতাবাহী অন্যান্য পাইক বরকন্দাজ দল থাকত পিছু পিছু। ঈদের জামাতে সুলতানদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ‘বাদশাহী কা তখ্ত।’ ‘নামাজের সময় সুগন্ধি গোলাপজল ছিটিয়ে দেয়া হতো। সুলতানদের উদ্যোগে মসজিদ আঙ্গিনায় নামাজ শেষে ঈদের খাবার দাবার বিতরণের প্রচলন ছিল। কখনোবা জৈষ্ঠ্যের প্রচণ্ড রোদে আমবাগানের ভেতরে, প্রশস্ত জায়গায় বা দীঘির তীরে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। প্রাসাদের আঙিনায় খোলা চত্বরে ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। রাজধানীতে ঈদকেন্দ্রিক নাগরিক বিনোদন কেমন ছিল তাও জানার খুব বেশি উপায় নেই। ধারণা করা যেতে পারে ঈদ আনন্দ উপভোগের জন্যে খাঁচায় আবদ্ধ হিংস্র জন্তুদের নিয়ে খেলাধুলার প্রচলন ছিল, লাঠি খেলা, মল্লযুদ্ধ ছাড়াও রাজদরবারে কাসীদা, রাজকবিদের ‘শায়ের’ এবং কাঞ্চনিদের নৃত্যগীত ও ছিল সুলতান, আমীর ওমরাদের বিনোদনের, উপভোগের প্রধান মাধ্যম। খাবারের মধ্যে বিভিন্ন গোশতের কাবাব, রুটি, মিষ্টান্ন, ফলমূল এবং পানিয় হিসেবে একধরনের সুমিষ্ট গোলাপজল ছিল প্রধান। মসলিন কাপড় ছিল হেরেমবালাদের পরম আরাধ্য কাপড়। খাসসা, মলমল, মসলিনের উত্তরীয়, আলোয়ানে, মূল্যবান পাথরের মালায় সজ্জিত হতেন সুলতান, শাহজাদা।
এই যে ঈদ, এই উৎসবের কীভাবে উদ্ভব হয়েছে তার ইতিহাস ও তথ্য সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র ও তথ্য থেকে বাংলাদেশে রোজাপালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের যে ইতিহাস জানা যায় তাতে ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ আগে থেকেই। বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম-প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব যে পূর্ব-বাংলায় পড়েছিল।
এ বিষয়ে নানা ইতিহাস গ্রন্থ পর্যলোচনা করলে আরও দেখা যায় অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে, এই সুফি, দরবেশ এবং তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সে যুগে তা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। এদেশবাসীর ধর্ম-সামাজিক পার্বণ নয়। এদেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় তাসকিরাতুল সোলহা নামক গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায় আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সন মুতাবিক ৯৪১ খৃস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে-ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খৃস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। তবে এদের প্রভাবে পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, তা বলা সমীচীন নয়। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওইসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন একথা বলাই সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ বা ‘খুদা হাফেজ’ শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানীরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ শব্দগুলি আরবীয় ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার।
ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন : ১৬৪০ খৃ. বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগা নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। নির্মাণকালে ঈগদাটি ভূমি থেকে বার ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগা। প্রথমদিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগার পাশে উনিশ শতকের শেষদিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগার পার্শ্বে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে। ঈদগাটি এখন সংরক্ষণ পুরাকীর্তি।
শামসুজ্জামান খান তার ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ নিবন্ধে বলেছেন ‘ঈদোৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকের বাংলায় ইসলাম এলেও চার/পাঁচশত বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিলো তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদোৎসবেও তেমন কোনো ঘটা লক্ষ্য করা যায় না। এর কারণ হয়তো দুটি: এক. গ্রাম-বাংলার মুসলমানেরা ছিলো দরিদ্র; এবং দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটাতো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ঈদোৎসব তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি ঊনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশারা ঈদোৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিলো অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসাবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিলো না। তবে গোটা ঊনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগর জীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে তাতে ঈদোৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।’
মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। তবে মুঘলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খোলামেলা গণমুখী শাহি ঈদগাহের উপস্থিতি দেখে। সুফিসাধকদের ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে আলাদা, অধিকতর গণমুখী। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকজ মেলা। সে ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। সামর্থের জোড়াতালির ভেতরও ঈদবাজার এখন অনেক বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর।
পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম, কিন্তু আয়োজন-প্রয়োজনে ব্যাপকতর। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। আরবদের ইহুদি ধ্যানধারণা ও জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই ঈদ ছিল আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য ঘোষিত উপহার। ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদ-উল- ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা উৎসব উদযাপন। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দু’টি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। আরবরা এ মেলায় অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কাজে মেতে ওঠতো। একই সাথে মেলায় আদিম উচ্ছ্বলতায়ও মেতে উঠত তারা। সেগুলো ছিল উচ্চবিত্তের খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলো শ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দে ভরা ঈদআনন্দ। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলামের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। ভিন্ন ধর্মে মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। ঈদ উৎসবে গতানুগতিক জীবনধারার অধ্যাত্মবাদের সাথে যোগ হয় প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা। তাই ঈদের আর্থসামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। ঈদের সাথে রমজানের আত্মশুদ্ধির কথাও বলা যেতে পারে। কারণ রোজার সাথে ঈদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। তাতে বদল হয়েছে ধর্মের অবিমিশ্র ও শুদ্ধ রূপেরও। যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমানের সাথে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক হলেও উৎসব অনুষ্ঠানে রকমফের সহজেই চোখে পড়ে। এর মুখ্য কারণ, পোশাক-আশাক ও খাদ্যাভ্যাসে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ।
পরিশেষে এই বলে শেষ করবো, আল্লাহ রাববুল আলামিন উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্মানিত করে তাদের এ দুটো ঈদ দান করেছেন। আর এ দুটো দিন বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ও সেরা ঈদ। ইসলামের এ দু’টো উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়। বরং এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসব এর সাথে সাথে এই আজমান জমিনের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা সুসজ্জিত করতে পারলেই ঈদের তাৎপর্য আরো বেশি উদ্ভাসিত হবে।
লেখকঃ প্রভাষক ও সাংবাদিক মোবা-০১৭১৮৮৬৩৮১১
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোফাচ্ছিলুল মাজেদ
মাজেদা মনজিল, মালদাহপট্টি
দিনাজপুর-৫২২০
মোবাঃ ০১৭১৪৯১০৭৭৯, ০১৭৭২৯৩৩৬৮৮
ই-মেইলঃ [email protected], [email protected]
দিনাজপুর বার্তা ২৪