বিরল সংবাদদাতা ॥ দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার ১০নং রাণী পুকুর ইউনিয়নের হালজায় গ্রামের ঝিনাইকুড়ি এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়া ৭ জুলাই বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টায় নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত রোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি এক পুত্র সন্তান ও দুই মেয়ে রেখে যান। এ দেশে প্রায় ৫০ এর অধিক আদিবাসী জাতীসত্তার মধ্যে হারিয়ে যেতে বসা একমাত্র কড়া সম্প্রদায়ের ২৪ টি পরিবারের ১ জন বয়োজেষ্ঠ্য ছিলেন থপাল কড়া। সম-অধিকার, সম-মর্যাদা তথা স্বাধীনতার জন্য বুকভরা আশা নিয়ে পাক হানাদার বাহীনিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য যিনি ১৯৭১ সালে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অবাক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার প্রায় ৫ দশক পার হওয়ার পরেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়া’র জীবন যাপিত হচ্ছিল অবহেলা, অসম্মান, বৈষম্য, ভূমি দখল, মামলা, দারিদ্রতা ও নিদারুন নির্যাতনের মধ্য দিয়ে থপাল কড়ার জীবন বাতি ধুকধুক করে জ¦লছিল। তার বার্ধক্য ও প্যারালাইসিস জীবনকে আরো কষ্টকর করে তুলেছিল। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া, হতাশা, দারিদ্রতাপৃষ্ঠ থপাল কড়া প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যেন সে মৃত্যুকেই আহবান করছিল। ঠিক এমন এক সময় উত্তরাঞ্চলের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইকো-সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজশন (ইএসডিও)’র প্রেমদ্বীপ প্রকল্প ও আর্ন্তজাতিক সংস্থা হেকস্-ইপার এর সহযোগিতায় গত ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে ‘থপাল কড়া’ তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রেমদ্বীপ প্রকল্পের কাজের মাধ্যমে। প্রেমদ্বীপ প্রকল্পের তৎপর যোগাযোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে হালজায় ঝিনাইকুড়ি গ্রামটি প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। গ্রামের কাঁচা রাস্তাটি পাকা হয়ে গেছে, এক সময় একটি ৬ ফিট বাই ৪ ফিট ঝুপড়ীর অন্ধকার ঘরে বসবাস করা সেই থপাল কড়া সরকারের আবাসন প্রকল্পের আওতায় দুই রুম, এটাচ বাথ ও কিচেন বিশিষ্ট সেমী পাকা সুন্দর বাড়ী তৈরী করে দেয়া হয়। চলাচলে অক্ষম থপাল করা সমাজসেবা থেকে পেয়েছিলেন হুইল চেয়ার এবং প্রতিবন্ধী ভাতা মৃত্যুর আগে। কিন্ত হায় হে বীর সেনা থপাল কড়া, পাননি তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ পূর্বে কোথাও নিবন্ধন না থাকার জন্য! প্রকল্পের কাজের শুরুতেই ইএসডিও এর চোখে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়া। তার আগে থেকেই তিনি অসুস্থ্য ছিলেন এবং বাকরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। তিনি শুধু বোঝাতেন যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। সেই থেকে ইএসডিও তার এলাকার সমবয়সী লোকজনের সাথে কথা বলে সত্যতা খুঁজে পান। সেই থেকেই ইএসডিও ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা করে কিছু কাগজপত্র প্রস্তুত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকায় প্রেরণ করেন এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল তার কাগজ নিয়ে। আজ জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়া এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি পেলেন না। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ আফসোস। আজকের পর থেকে কে দিবে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি? এলাকাবাসী জানান থপাল কড়া একজন শক্ত মনের মানুষ ছিলেন এবং সবসময়ই গুনগুন করে দেশাত্ববোধক গান গাইতেন। তিনি অত্যান্ত ভালো এবং অনেক বড় মনের একজন মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যতে এলাকায় গভীর শোকের ছাঁয়া নেমে এসেছে। তার ছেলে সুমন কড়া আক্ষেপ করে বলেন, “আমার বাবা এই দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কিন্তু তিনি জীবনের শেষ সময়ে এসেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না, জাতির কাছে এটাই আমাদের বড় আক্ষেপ”। উল্লেখ্য যে, ১০নং রাণী পুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ফারুক আযম দুঃখ করে বলেন, “অনেক দিন ধরে থপাল কড়ার রাষ্ট্রীয় মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতির জন্য অনেক চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ হলাম! আমরা প্রার্থনা করি সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে স্বর্গবাসী করেন”। চেয়ারম্যান সাহেব তার নিজ নেতৃত্বে এলাকার সবাইকে নিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন এবং শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাকে স্যালুট জানান। বিরল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা সুলতানা মৃত্যর সত্যতা নিশ্চিত করে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। ইএসডিও নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান, হেকস-ইপার এর আবুল হাসনাত, ম্যানেজার ফিন্যান্স এন্ড এডমিন, সাইবুন নেসা, ম্যানেজার অ্যাডভোকেসি এন্ড রাইটস বেজড্ ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম, ভূপেশ রায় ম্যানেজার মার্কেট ডেভলপমেন্ট, শেখর চক্রবর্তী পার্থ প্রোগ্রাম অফিসার, চিত্ত ঘোষ আজকের দেশ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক, আবুল কাশেম উরু কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিরলসহ এলাকার সবাই থপাল কড়ার মৃত্যতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানান। ইএসডিও-প্রেমদ্বীপ প্রকল্পের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কাজী সিরাজুস সালেকিন, সমন্বয়কারী, শাহ্ মোঃ আমিনুল হক, ম্যানেজার অ্যাডভোকেসি, অরুণ চন্দ্র শীল, উপজেলা ম্যানেজার, নজরুল ইসলাম, সিএফসহ আরও অনেকে।