স্টাফ রিপোর্টার :-সাংবাদিক আহসানুল আলম সাথীর মৃত্যু সংবাদ যখন পাই তখন আমি লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে ছিলাম। ৯ আগস্ট ২০১৮ রাত ১২টায় মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু আমি তার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম ১০ আগস্ট দুপর ১২টায়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে সংঘটিত গণহত্যা-বধ্যভূমি নিয়ে একটি গবেষণা কাজে তখন লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে অবস্থান করছিলাম। সেখানে পৌঁছানের পর মোবাইল ফোনের মেসেজ অপশনে দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বরুপ বকসী বাচ্চুর একটি মেসেজ পাই, যেখানে লেখা ছিল দিনাজপুরের প্রথিতযশা সাংবাদিক আহসানুল আলম সাথী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। মেসেজ পেয়ে বন্ধু শামীম রেজাকে ফোন দিয়ে আরো ভালভাবে জেনে নিয়েছিলাম যে, কিভাবে তিনি মারা গেলেন। আমার দূর্ভাগ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে সাথীর জানাজায় অংশ গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। সেই বেদনা এখনো মনের মধ্যে কাঁটা দেয়।
আহসানুল আলম সাথীকে নাম ধরে ডাকতাম। কিন্তু তিনি আমাকে ডাকতেন উকিল ভাই বলে। এর কারণ হলো সাথীর পিতা, দিনাজপুর জেলার বিশিষ্ট কবি মরহুম আ. কা. শ. নুর মোহাম্মদ আমার সবচেয়ে বড় বোন নূর সিদ্দিকা ওরফে রেহানা’র বিয়েতে উকিল দিয়েছিলেন। তিনি আমার পিতা মরহুম ডা. আব্দুল আজিজ এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আবার আমার মা মরহুমা লুৎফন নেছা তাকে ‘ভাইজান’ বলে সম্বোধন করতেন। মায়ের সূত্রে আমি এবং আমার দুই বোন আ. কা. শ. নুর মোহাম্মদকে ‘মামা’ বলতাম।
আমার মা জন্ম সূত্রে চাঁপাই নবাবগঞ্জের মেয়ে ছিলেন। আবার আ. কা. শ. নুর মোহাম্মদ ছিলেন চাঁপাইয়ের মানুষ। বয়সে বড় ছিলেন বলে তিনি আমার মায়ের কাছে ‘ভাইজান’ এবং মায়ের সূত্রে আমাদের ‘মামা’ হয়েছিলেন।
বড় বোনের বিয়ের সাল-তারিখ মনে নেই। তবে এটা মনে আছে যে, আমি তখনো মেট্রিক পাস করি নাই। সম্ভবত আমি ৮ম অথবা ৯ম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল। সেই সময় আ. কা. শ. নুর মোহাম্মদ মামা প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বাবার গনেশতলাস্থ ‘নর্দার্ন হোমিও ফার্ম্মেসী’তে গিয়ে বসতেন এবং গল্প করে, পেপার পড়ে সময় কাটাতেন। তিনি বাবার অনুরোধে পাটুয়াপাড়া হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয়ে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাও করতেন এবং মাঝে মাঝে আমাদের পাটুয়াপাড়ার বাসায় গিয়ে মায়ের ভাল-মন্দ খোঁজ খবর নিতেন।
আমার বড় বোনের বিয়েতে উকিল দেয়ার জন্য বাবা আ. কা. শ. নুর মোহাম্মদ মামাকে অনরোধ করলে তিনি তাতে রাজি হন এবং উকিল দিয়ে আমার বোনের উকিল বাবায় পরিণত হন। আহসানুল আলম সাথী সেই সূত্রে আমাকে নাম ধরে না ডেকে বেশির বাগ সময় ‘উকিল ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। সাথী প্রায়ই আমাকে দেখিয়ে মজা করে বলতেন, ১০টা নয় ৫টা নয় একটাই আমার উকিল ভাই। ইচ্ছা করলেই আরেকটা উকিল ভাই বানাতে পারব না, কারণ আমার এখন বাপও নাই, মাও নাই।
একজন নিবেদিত প্রাণ সাংবাদিক ছিলেন আহসানুল আলম সাথী। তার সাংবাদিকতায় আসা ছিল পারিবারিক সূত্রে। বাবা, মা, ভাইদের দেখাদেখি এই লাইনে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিক পরিবারের সন্তান। বাবা তো বটেই, মা বেগম আজিজা এন মোহাম্মদ, ভাই আখতারুল আলম বুলু, আহ্বাবুল আলম দুলাল, বর্তমানে ফ্রান্স প্রবাসী আরেক ভাই শান্তি, তারাও কখনো না কখনো সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন।
আহসানুল আলম সাথী এক সময় বেশ মোটা- সোটা ছিলেন। পেট যথেস্ট বড় ছিল। ভুড়ি হয়েছিল। কারণ তিনি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খেতে পারতেন। কিন্তু যখন ধরা পড়ল যে, তার শরীরে ডায়াবেটিস আছে, উচ্চ মাত্রায় রক্ত চাপও আছে তখন তিনি খাওয়া-খাদ্যে সাবধান হয়ে গেছেন। যে খাবার তার শরীরের জন্য নিষেধ তা এড়িয়ে চলেছেন। মাংস খাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত খেতে গিয়ে হাতের কাছে মাছ-মাংস থাকা সত্বেও সেগুলো ছুঁয়েই দেখতেন না, সবজী দিয়ে খাওয়া সেরে চলে আসতেন। এর ফলে ৫৭ বছর বয়স পর্যন্ত মোটামুটি সুস্থ্যই ছিলেন তিনি। যখন মারা গেছেন অকস্মাৎ প্রেসার উঠে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অনেকটা তাৎক্ষণিক মৃত্যু বরণ করেছেন।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামীম রেজাও মারা গেলেন অকস্মাৎ, অনেকটা সাথীর মত। ২২ মে আছর নামাজ পড়ার সময় পড়ে যান, তারপর মৃত্যু। অকস্মাৎ মৃত্যু। অবশ্য এর আগে গত এক দেড় বছর ধরে তিনি কয়েক দফায় হাসপাতাল যাওয়া-আসা করেছেন। একাধিকবার হাসপাতালে থাকতেও হয়েছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, আমি অসুস্থ্য, দোয়া করবেন। চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফিরেও এসেছেন, শুরু করেছেন স্বাভাবিক কর্ম জীবন। সর্বদাই কাজের মধ্যে থাকতেন। কাজকে ভাল বাসতেন। তার হাতে তৈরী নিউজ বেশ ক’জন সাংবাদিক নিজেদের পত্রিকায় পাঠাতেন।
শামীম রেজা বাবার হাত ধরে ফটোগ্রাফিতে এসেছিলেন, তারপর আসেন সাংবাদিকতায়। দুই জগতেই সফল ছিলেন। তার জীবন সাথী নির্বাচিত হয়েছে ফটোগ্রাফির সূত্রে। সেই ঘটনা হয়ত অনেকের জানা নেই। সেটা আজ বলব।
শামীম রেজার পিতা মরহুম রফিকুল ইসলাম এক সময়ের সুপরিচিত দিনাজপুর ফটো স্টুডিওর মালিক ছিলেন। ফটোগ্রাফিতে শামীমের হাতেখড়ি সেখানেই। একদিন সেখানে ছবি তুলতে এসেছিলেন কলেজ পড়–য়া এক মেয়ে। এর দু-একদিন পর ছবির ডেলিভারি নিতে এসে মেয়েটি দেখেন যে, তার যে ছবি তাকে দেয়া হয়েছে সেই ছবির গালে তিল রয়েছে। এতে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান, কারণ বাস্তবে তার তিল ছিল না। ব্যাপারটা কি ? প্রশ্ন করে জানতে পারেন যে, গালে তিল না থাকলেও শামীম ফটোগ্রাফি করে তার গালে তিল বসিয়ে দিয়েছে। এতে না কি তাকে খুব সুন্দর দেখাবে। এ নিয়ে প্রথমে হাসাহাসি, তারপর প্রেম, তারপর বিয়ে। সেই মেয়েটির নাম ছিল লাভলী। তিনিই পরে শামীম রেজার জীবন সাথীতে পরিণত হন। ফটোগ্রাফিতে এর চেয়ে বড় সফলতা আর কি হতে পারে?
শামীম রেজার পিতা ফটোগ্রাফির সাথে সাথে দৈনিক উত্তরায় ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। সেই সূত্রে ফটো সাংবাদিকতায় আসেন শামীম রেজাও। এক পর্যায়ে পুরো মাত্রায় রিপোর্টিং শুরু করেন এবং সফল ও কঠোর পরিশ্রমী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার লেখা সংবাদ বাংলাদেশের অনেক বড় বড় সংবাদপত্রে ছাপানো হয়েছে, কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সেগুলোর বেশিরভাগ তার নামে আসে নাই। এসেছে অন্যের নামে। বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে অনেক সাংবাদিকের পরিশ্রম কমেছে। কারণ একজনের তৈরী নিউজ আরেকজন এক-দু লাইন ঘষামাজা করেই নিজের নামে চালিয়ে দিতে পারেন।
শামীম রেজা অনেকটা সরল প্রকৃতির ছিলেন। একটুতেই রেগে যেতেন আবার অল্পতেই মুখে হাসি ফুটত। তার সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই তার পকেট কেটেছে। পকেট কাটা বলতে তার কাছ থেকে এটা খাওয়া, ওটা খাওয়া। আমি প্রায় প্রতিদিনই তার কাছ থেকে চা খেতাম, সেই সাথে এক টুকরো বিস্কুটও। এই রকম আমার মত অনেকেই চা-বিস্কুট খেয়ে তার পকেট ফাঁকা করেছে। মিজানুর রহমান লুলু ভাই, কিংবা চিত্তদা, তারাও তার কাছে এটা সেটা খেতেন। খাওয়ানোর ব্যাপারে শামীম রেজা যথেষ্ট উদার ছিলেন।
আবার তিনি নিজেও খাওয়া-দাওয়ায় কম ছিলেন না। আহসানুল আলম সাথীর মত তারও ডায়াবেটিস ও প্রেসার ছিল। সাথী খাওয়া-দাওয়ায় কন্ট্রোল আনতে পারলেও শামীম পারতেন না। তার মুখে সব সময় এটা সেটা খাবার থাকতই। ডায়াবেটিসের কারণে খাওয়ার মধ্যে যে ধরণের নিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল তা তিনি মানতেন না। ঘুম আর নামাজের সময় বাদ দিলে দিনের বাকি সময়ের পুরোটাতেই তার মুখে বাদাম, মুড়ি, পেয়ারা, সিঙ্গারা, নিমকি ইত্যাদি কোন না কোন খাবার লেগে থাকত। তার খাবারের সাথে সাথে আমাদেরও কম বেশি খাওয়া হতো
শামীম উচ্চ মাত্রায় প্রেসারের রোগী ছিলেন। তার জন্য মুরগীর মাংস কিছুটা গ্রহনযোগ্য হলেও মুরগী খেতেন না। খাসির মাংস তার জন্য বিষ হলেও খাসির মাংসই সবচেয়ে বেশি খেতেন। খালপাড়ার মুন্সী হোটেলের তেল-চর্বি যুক্ত খাসির মাংস আর বড় সাইজের মাছের মাথা না খেলে কিছুতেই তার ক্ষুধা দূর হতোনা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার শরীরের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় এমন সব সু-স্বাদের খাবার খেয়ে গেছেন। সাথীর সাথে তার পার্থক্য হলো যে, তিনি মারা গেছেন খেয়ে, সাথী মারা গেছেন খাওয়া কন্ট্রোল করে। তবে এই দুজনের কেউই দীঘদিন বিছানায় পড়ে ছিলেন না।
যত কিছুই হোক, শামীম রেজা কখনো নামাজ বাদ দিতেন না। শীত, গ্রীস্ম, বর্ষা কোন সময়ই নামাজ বাদ যেত না তার। যখন তিনি মারা যান তখনো নামাজে ছিলেন। ২২ মে ২০১৯ আছড়ের নামাজে দাঁড়িয়েই পড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন।
নানা কারণে শামীমের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। ২০০৪ সালে আমার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বই বিক্রির জন্য শামীম রেজা ও কাশি কুমার দাস আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। এ কারণে কেউ কেউ আমাদেরকে মজা করে কাজুশ (কাশি+জুয়েল+শামীম) বলতেন। এখন আর কাজুশ থাকল না।
আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল ঢাকায়। বিয়ের আগে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় কোথায় উঠব এরকম যখন ভাবছিলাম তখন শামীম তার মেয়ে নিশির সাথে আলাপ করে আমাদেরকে নিশির শ্যামলীর বাসায় ওঠার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
খবর সংক্রান্ত বিষয়ে আমার ও শামীমের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। সেই মামলার রায় গেছে আমাদের বিরুদ্ধে। আমরা আপীল করেছি। আপীল অবস্থায় শামীম আমাকে এবং আমাদের সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন। আমার জন্য শামীমের অনেক অবদান আছে। কোন অবদান শোধ দেয়া যায় বলে আমি বিশ^াস করি না। তাই শামীমের কাছে ঋণী থেকে গেলাম।
আহসানুল আলম সাথীর জানাজা ও দাফনে থাকতে পারিনি, এটা আমার জন্য বেদনার। আবার শামীমের জানাজা ও দাফনে ছিলাম সেটাও ছিল বেদনার। তারা ভাল থাক, পরলোকে আল্লাহু রাব্বুল আল আমীন তাদেরকে ভাল রাখুক, বেদনাহত মন নিয়ে কামনা করি সেটাই। -আজহারুল আজাদ জুয়েল, সাংবাদিক-কলামিস্ট