ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১৩ আগস্ট ২০২০
  1. অন্যান্য
  2. অর্থ ও বাণিজ্য
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কাহারোল
  5. কুড়িগ্রাম
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খানসামা
  9. খেলা
  10. গাইবান্ধা
  11. ঘোড়াঘাট
  12. চাকরী বার্তা
  13. চিরিরবন্দর
  14. জাতীয়
  15. ঠাকুরগাঁও
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পাড়ার নাম পাটুয়াপাড়া

মোফাচ্ছিলুল মাজেদ
আগস্ট ১৩, ২০২০ ১:৪৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আজহারুল আজাদ জুয়েল :

দিনাজপুর জেলা শহরের প্রাণনাথপুর মৌজার ভিতরের যে পাড়ায় আমি বসবাস করছি তার নাম পাটুয়াপাড়া। কেউ কেউ বলেন, আগে এটা ‘পাটোয়াপাড়া’ ছিল, কিন্তু কালক্রমে ভুল উচ্চরণে ‘পাটুয়াপাড়া’ হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত এই পাড়া মহল্লা হিসেবে বেশ বড়। এই পাড়ার ভিতরে পাকিস্তান আমলে মসজিদ ছিল ৩টি, এখন আছে ৫টি। সবকটি মসজিদেই শুক্রবারের নামাজে উপচে পড়া ভিড় থাকে। মসজিদ ঘর ছাড়িয়ে বাইরেও নামাজী লোকের ব্যাপক সমাগম হয়ে থাকে। এর থেকে এই পাড়া কত বড়, তা আন্দাজ করা যেতে পারে। বৃটিশ আমলে এই পাড়ায় স্বল্প সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বসবাস ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। যেমন সাজ্জাদ আলী, পিতা- মৃত সোলেমান মিয়ার বর্তমান বাড়িটি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুগি বাবুর। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাড়িটি সোলেমান মিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
পাটুয়াপাড়াকে ঘিরে আছে লালবাগ, রামনগর, মুদিপাড়া ঘাসিপাড়া, চাউলিয়াপট্টি, ক্ষেত্রিপাড়া ও এনায়েতপুর। এই পাড়াগুলিও মুসলিম পাড়া। পাড়াগুলো তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর এলাকা এখনো। শিক্ষার প্রতি অনীহা এবং স্বল্পমূল্যের পেশা এর কারণ। তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই। এখন পাটুয়াপাড়াহর এইসব পাড়ার সকল ছেলে-মেয়েই লেখাপড়া করে। অধিবাসীদের পেশা ও জীবন মানও অনেক উন্নত।
পাটুয়াপাড়ার পার্শবর্তী এলাকাগুলো সম্পর্কে জানা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগে লালবাগ গোরস্থান এলাকা ঘণ জঙ্গলে আচ্ছাদিত ছিল এবং প্রায়ই বাঘ দেখা যেত। এখন অবশ্য বাঘ দূরের কথা খেকশিয়ালও দেখা যায় না। ঘাসিপাড়া এলাকটি বিহারিদের প্রধান আবস্স্থল ছিল পাকিস্তান আমলে। তখন ঐ পাড়ার লোকের চালচলন আর পাটুয়াপাড়ার মানুষের চালচলন ছিল সম্পুর্ণ ভিন্ন। এনায়েতপুর যদিও একটি ক্ষুদ্র পাড়ার নাম তবে এর বাসিন্দারা নিজেদেরকে পাটুয়াপাড়ার পরিচিতি দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এই কারণে দিনাজপুর শহরে এনায়েতপুরের পরিচিতি তেমন একটা নেই। মুদিপাড়া ও পাটুয়াপাড়ার লোকের মধ্যে নৈকট্য খুব বেশি দেখা গেছে বরাবরই। রামনগরে একটি বাজার থাকার কারণে এইসব পাড়ার লোকের মিলনস্থল হয়েছে ঐ বাজার। আর ছয় রাস্তার মোড় পাটুয়াপাড়াকে অতিমাত্রায় বিখ্যাত করেছে কারণ, দিনাজপুর ছয় রাস্তা যুক্ত মোড় আছে একটাই, সেটা পাটুয়াপাড়ার ভিতরে।
নামকরণের ব্যাখা: এই পাড়াটির নাম কেন পাটুয়াপাড়া তার সঠিক ব্যাখ্যা জানা নেই। ছোট বেলায় অনেককে পাট দিয়ে রশি বানাতে দেখেছি। অনেকের মতে সেটাই হলো নামকরণের উৎস। অর্থাৎ পাট থেকে পাটুয়াপাড়া। এই পাড়ায় জন্মসূত্রে আছেন শামসুল আলম (৬১), পিতা- মৃত মসিরউদ্দিন, মাতা-মৃত সুন্নাতুন নেছা। পৈতৃক সূত্রে পেশায় একজন দলিল লেখক তিনি। তার মতে, পাটুয়াপাড়ায় এক সময় বড় বড় পাট ব্যবসায়ীরা ছিলেন। বৃটিশ রেকর্ডে পাটোয়া বংশ নামে একটি বংশের অস্তিত্বও পাওয়া গেছে। আছের পাটোয়া, বশির পাটোয়া, নাছের পাটোয়া প্রমুখ ছিলেন পাইকারি পাট ব্যবসায়ী। তাদের পাটোয়া টাইটেল থেকে পাটোয়াপাড়া নামের উৎপত্তি, যা এখন পাটুয়াপাড়া হয়েছে।

প্রাণনাথপুর মৌজার মানচিত্র। এই মৌজাতেই পাটুয়াপাড়ার অবস্থান।
পাটুয়াপাড়া ১ নম্বর জামে মসজিদের সভাপতি শরিফউদ্দিন আহমেদ জানান যে, আছের পাটোয়ার ছেলে খাজিরউদ্দিন পাটোয়া, তাজিরউদ্দিন পাটোয়া ও মফিজউদ্দিন পাটোয়া প্রথমে পাট ব্যবসা করতেন। পরে বটি, চুরি, বদনা, সিঁদুর ইত্যাদি শাখারী ব্যবসায় যুক্ত হন। তার দুই মেয়ের একজন হলেন রেজিয়া সোপের প্রতিষ্ঠাতা নাজিরউদ্দিনের মা।
পাটুয়াপাড়ার ৬৬ বছর বয়সী মখলেসুর রহমান, পিতা- মৃত নুরুল ইসলাম, মাতা- মেরীনা খাতুন বলেন, পাটোয়ারা পাট ব্যবসার সাথে সাথে মাছ ধরা বনছি, সুতা, ভুত তাড়ানো ও রোগ সারানো তাবিজ বিক্রি করতেন। তাদের ব্যাপক পরিচিতি ছিল এবং তাদের পাটোয়া টাইটেল থেকে পাটুয়াপাড়া নামের উৎপত্তি হয়েছে।
উপরে যে সকল নাম আছে তারা ছাড়াও পাটুয়াপাড়ার আরো উল্লেখযোগ্য পাট ব্যবসায়ী ছিলেন জলিলউদ্দিন হাজী, জমিরউদ্দিন হাজী, গোলাম রাব্বানী ডেপুটি সাহেব প্রমুখ। তারা পাট ব্যবসার সাথে সাথে অন্য ব্যবসাও করতেন। তবে পাটের সাথে একটি নিবিঢ় সম্পর্কের বিষয়টি আমার (লেখক) নিজেরই দেখা। আমি আমার ছোট বেলা থেকে জেনেছি যে, বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে, পাটুয়াপাড়ার প্রায় সব বাড়িতেই বয়স্ক নারী-পুরুষেরা পাটের দড়ি তৈরী করতেন। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি নিজেই আমার দাদী নুরজাহান বেওয়াকে ঢেড়ায় পেঁচিয়ে পাটের দড়ি তৈরী করতে দেখেছি। তিনি নিজ হাতে তৈরী করা দড়ি বিক্রি করে পান-সুপারি কিনতেন। আমার ছোট বেলায় এই রকম আরো অনেক বয়স্ক নারী ও পুরুষকে দড়ি কাটতে দেখা গেছে। যেমন ভটনের দাদী, আমিনুলের মা অকেজা বেওয়া, জব্বার সোনাহারের মা কালঠি বেওয়াসহ আরো অনেক বিধবা মহিলা পাটের দড়ি বানিয়ে পান-সুপারির পয়সা যোগাড় করতেন। তাই পাট থেকে পাটুয়াপাড়া নামের উদ্ভব হলেও হতে পারে। তবে পাটুয়াপাড়ার বর্তমান সময়ের লোকদের এটাই বিশ^াস যে, পাট নয়, পাটোয়া থেকে পাটুয়াপাড়া নামটি এসেছে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, নাটোর জেলা শহরেও ‘পাটোয়াপাড়া’ নামের একটি পাড়া আছে। কিন্তু আমার জানা নেই যে, সেই গ্রামে কোন পাটোয়া বংশ ছিল কি না এবং পাট সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে কেউ যুক্ত ছিলেন কি না।
পেশা ভিত্তিক পর্যালোচনা : এবার পাটুয়াপাড়া নিয়ে একটু পেশা ভিত্তিক পর্যালোচনা করা যাক। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে পাটুয়াপাড়ার অনেকে পাটের পাশাপাশি চামড়া ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। জলিল হাজী, জমির হাজী, কালুয়া কমিশনারের তখন জমজমাট ব্যবসা ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনেকে চামড়া ব্যবসা অব্যাহত রাখেন। মো. আমানউল্লাহ আমান ও তার ছোট ভাই শহিদুল্লাহ এখনো চামড়ায় যুক্ত আছেন। তবে প্রবীণদের মতে পাটুয়াপাড়ার লোকজনের মধ্যে পান বিক্রির প্রবণতা এক সময় খুব বেশি ছিল। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে পাটুয়াপাড়ার মহি পানুয়া, তমিজ পানুয়া, ইউসুফ পানুয়া, জব্বার পানুয়া, সাত্তার পানুয়া, আশু পানুয়া, আইজুল পানুয়া, ইউনুস পানুয়া, লালচান পানুয়া, বুধু পানুয়া, শেরু পানুয়া, কষ্টু পানুয়া, আতি পানুয়া, পাকু পানুয়া, সিরাজ পানুয়া, রিয়াজ পানুয়া, ফজল পানুয়া, হাবিব পানুয়া, লালচান মিয়া ওরফে লালু পানুয়া, আছির পানুয়া, মতে পানুয়া, মতি পানুয়াসহ আরো অনেকের নাম শোনা যায় যারা পান ব্যবসা করতেন। পান ব্যবসা করার কারণে তাদের পরিচিতিতে নামের সাথে ‘পানুয়া’ বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। আবার অনেক পানুয়ার ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হয়ে উন্নত পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণে তাদের পিতার পানুয়া পরিচিতি হারিয়ে গেছে। যেমন মরহুম অধ্যাপক মনসুর আলী ও মখলেছুর রহমানের পিতা মজিরউদ্দিন, প্রফেসর সাইফুর রহমানের পিতা মহিউদ্দিনৎ পান ব্যবসায়ী হলেও এখনকার প্রজন্মের কাছে তাদের পানুয়া পরিচিতি নেই। পানুয়াদের পরিবারের কেউ কেউ এখনো এই পেশার সাথেই আছেন। যেমন জব্বার পানুয়ার ছেলে ভুট্টো পান পেশায় জড়িত।
পানের খিলির অন্যতম উপকরণ সুপারি, জর্দা, খয়ার ইত্যাদি। পাটুয়াপাড়ার অনেকে সুপারি বিক্রির সাথেও জড়িত ছিলেন। সোবাত আলীর পিতা ওলেমান মিয়াসহ আরো অনেকে সুপারির ব্যবসা করতেন পাকিস্তান আমলে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাফায়েত হোসেনসহ আরো কেউ কেউ সুপারি, খয়ার, জর্দা বিক্রি করেনন বাহাদুর বাজার, চক বাজার ও রেল বাজারে।
পাটুয়াপাড়ার অনেকে মুদি ব্যবসায় জড়িত ছিলেন এবং এখনো আছেন। আমার (লেখকের) দাদা কুদ্দুস মিয়া বৃটিশ আমল হতে চক বাজারে মুদি ব্যবসা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাটুয়াপাড়ার ভিতরে একমাত্র মুদিখানা ছিল ছয় রা¯তার মোড়ে, যার মালিক আতাবউদ্দিন। পরে রফিক, ফটন, বাবু, মংলুসহ অনেকেই মুদিখানা খোলেন।
অনেকে সাবান ব্যবসায় খুব ভাল করেছেন। আলহাজ¦ নাজিরউদ্দিন প্রতিষ্ঠিত রেজিয়া সোপ ফ্যাক্টরী এখনো দিনাজপুরের বড় সাবান ফ্যাক্টরী। আবুল হোসেনের পাকিস্তান সোপ ফ্যাক্টরীও বেশ পরিচিত ছিল। পাটুয়াপাড়ার কিছু লোক হাটে হাটে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করতেন। আবুলের ভাই কাশেম হাটে হাটে বিক্রি করতেন সাবান। মিন্টুর বাবা, বারেকের পরিবার কাপড় বিক্রি করতেন। জুয়েলের বাবা হাটে হাটে রোগী দেখে ঔষধ দিতেন। আফালউদ্দিন সুতা বঞ্চির ব্যবসায় নাম করেছিলেন। তার হাত ধরে সুতা-বঞ্চির ব্যবসায় আসেন খসড়া আজিজুল। জবেদ আলী মাষ্টারের পিতা ডালের ব্যবসা করতেন।
ডিলারী ব্যবসাও ছিল কারো কারো। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলেন দাদা কোম্পানীর ডিলার সাহাবুদ্দিন। সব ধরণের তেল, পাথর, চুন, লবনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী ও রপ্তানী করতেন। মালামাল আসত জাহাজে ও ট্রেনে ভারত, চীন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পাটুয়াপাড়ায় প্রথম টেলিফোন সংযুক্ত হয়েছিল তার বাসায়। তিনি রেশন ডিলারও ছিলেন। স্বাধীনতার পর তার পুত্র এম হোসেন মুকুল অল্প কয়েক বছর রেশন ডিলারী করেছেন। দিনাজপুরের টাউন হল, হেমায়েত আলী হল ও হেমায়েত আলী পাবলিক লাইব্রেরির (তদানীন্ত খাজা নাজিমুদ্দিন পাবলিক লাইব্রেরি) ভবন নির্মাণে অবদান রেখেছেন বলে জানা যায়। অন্য এক সাহাবুদ্ধিন ছিলেন গাড়োয়ান। তিনি গরুর গাড়ি চালাতেন। পরে তার ছেলে ইয়াকুব, যিনি ধাধুয়া নামে বেশি পরিচিত ছিলেন তিনিও গাড়োয়ান হয়েছিলেন।
পাটুয়াপাড়ার কিছু লোক বৃটিশ আমল থেকে মৌসুমী ফলের ব্যবসা করতেন। আজিরউদ্দিন গনেশ, মো. আলিমউদ্দিন, গোলাম রসুল বক্স ওরফে চেন্দেরা, জনৈক পিঞ্জু আম, লিচুসহ বিভিন্ন রকমের ফলের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। গোলাম রসুল বকস বা চেনদেরা মূলত ডাব বিক্রি করতেন। সিজিনকালে বাগান নিয়ে আম বিক্রি করতেন মো. আলিমউদ্দিন। বর্তমানে মনা, নিশানসহ আরো অনেককে ফলের ব্যবসা করতে দেখা যায়।
সোনাহারি পেশায় ছিলেন কিছু লোক। বৃটিশ আমলে আছিরউদ্দিন সোনাহার ও অফিরউদ্দিন সোনাহারের নাম ডাক ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জব্বার সোনাহারের নাম ছড়িয়েছিল। জব্বার সোনাহারকে কেন্দ্র করে আইজুল, আসলাম, সালাম প্রমুখ এই পেশায় এসে ভাল করেছিলেন।

পাটুয়াপাড়া ঈদগাহ মাঠ

দিনাজপুরের প্রখ্যাত হাসনা বিলাস তেলের ম্যানুফ্যাকচারার ছিলেন তমিজউদ্দিন আহমেদ, যিনি দাবা তমিজ নামে খ্যাত হযেছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে হাসনা বিলাস তেল পরে ফজলুর রহমান বাজারজাত করেন। দাবা তমিজের আরো দুই পুত্র মানিক ও মুক্তা অন্য নামে দুইটি ভিন্ন তেল উৎপাদন ও বাজারজাত করতেন। কষ্টুমিয়া নামের একজন ছিলেন যিনি হাট-বাজারের ডাক নিয়ে খাজনা তুলতেন। মহারাজা নিজেই তাকে হাট দিতেন বলে প্রবীণরা জানিয়েছেন।
পাটুয়াপাড়ায় চাকুরিজীবী লোকের সংখ্যা কম। প্রফেসর শিক্ষক ব্যতিত অন্য্য চাকুরি জীবীদের মধ্যে আলহাজ¦ ইয়াকুব আলী পোষ্ট মাষ্টার হিসেবে চাকুরি করেছেন দীর্ঘকাল। আব্দুর রশিদ, যিনি এখন ঘাসিপাড়ায় হোমিও চিকিৎসা করে থাকেন তিনিও পোষ্ট মাষ্টার ছিলেন। মফিজউদ্দিন নামের একজন ছিলেন ডিসি অফিসের কেরানী। রায় সাহেব বাটির জমিদারী থাকা অবস্থায় পাটুয়াপাড়ার মাওলা বক্স সেখানে মুন্সীগীরী করতেন। কথিত আছে যে, রায়সাহেব বাটির ভিতরে পায়ে জুতা, স্যান্ডেল পড়ে কেউ ঢুকতে পারতেন না। কিন্তু বিশেষ সম্মনী ব্যক্তি হিসেবে মুন্সী মাওলা বক্সকে খড়ম পড়ে ঢুকতে পারতেন। মাওলা বক্স এর বিশালাকৃতির দাড়ি ছিল। তার দাড়ি পায়ের হাটু ছাড়িয়ে নীচে ঝুলে পড়ত। তাই তিনি দাড়ি বেনী করে ভাঁজ করে রাখতেন। জমিদার রায় সাহেব তার সেই লম্বা দাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে মসকরা করতেন। ইদানীং গাছ ও খড়ি বেচাকেনার সাথে অনেকে জড়িত। মিলন, লুৎফর গাছ কিনে নিয়ে কোনটা খড়ির াাকারে কোনটা ফার্ণিচারের কাঠ হিসেবে বিক্রি করেন। মিলন ফার্নিচারের ব্যবসাওও করেন। গ্রীল ব্যবসায় জড়িত অনেকে। রফিক ছয় রাস্তার মোড়ে, ইসমাাইল রামনগড়ে গ্রীলের দোকান দিয়েছেন। এভাবে পাটুয়াপাড়ার আরো অনেকে নানান পেশায় যুক্ত ছিলেন এবং এখনো আছেন।
শিক্ষা ও শিক্ষকতা : শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন পাটুয়াপাড়ায় এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। হেমায়েত আলী ও সাখাওয়াত হোসেন দিনাজপুর সরকারি কলেজের প্রফেসর ছিলেন। তারা শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন। সরকারি কলেজের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সফিকুল ইসলাম ঐ কলেজে অধ্যক্ষর পদ অলংকৃত করে পাটুয়াপাড়াকে সম্মানের আসনে নিয়েছিলেন। তিনি দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও ছিলেন। অধ্যাপক সাইফুর রহমান ও অধ্যাপক মনসুর আলী আদর্শ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আব্দুল কাদের ছিলেন সরকরি কলেজের ডেমেনেষ্ট্রেটর। নূর-ই-আলম সিদ্দিকী ইংরেজী বিভাগে শিক্ষকতা করছেন দিনাজপুর সিটি কলেজে। সম্ভবত পাটুয়াপাড়ার প্রথম বিসিএস ক্যাডার তিনি। এই কলেজে আসার আগে পর্যায়ক্রমে পীরগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ, দিনাজপুর সরকারি কলেজ ও গাইবান্ধা সরকারি মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। মারুফা বেগম ফেন্সী পাটুয়াপাড়ার একমাত্র কৃতি সন্তান যিনি পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রী লাভ করেছেন। চাঁদগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে শিক্ষকতা শুরু করলেও বর্তমানে সংগীত ডিগ্রী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এই কলেজেই ডেমোনেষ্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার সহদোর নুরুল মতিন সৈকত। জায়েদী পারভেজ অপূর্ব কেবিএম কলেজে ক্রিড়া শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন। রাজিয়া বেগম আছেন আদর্শ কলেজে।
অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলামের পিতা আব্দুল জব্বার সারদেশ^রী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। জব্বার স্যার হিসেবে অধিক পরিচিতি ছিল তার। শিক্ষক হিসেবে ব্যাপক সুনাম ও মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিলেন। আনসার আলী ছিলেন বিরলের কাঞ্চন এলাকার রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যাণলয়ের প্রধান শিক্ষক। সুনাম ছিল তারও। স্কুলে যাওয়ার পথে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। দিনাজপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক জবেদ আলী। জবেদ মাষ্টার নামে তিনি অধিক পরিচিত। আব্দুস সাত্তার মন্টু হলেন একাধারে কবি, শিক্ষক ও কাফেলার গানের লেখক। তিনি সেতাবগঞ্জের একটি কলেজের প্রধান শিক্ষক ও জাগরণী ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তার পিতাও শিক্ষকতা করতেন এবং আছির পন্ডিত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লাভলী বেগম তার পিতার প্রতিষ্ঠিত ওয়াজিফা সামাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে অবসরে গেছেন। বর্তমানে মোসাদ্দেক হোসেন আছেন এই দায়িত্বে। আবুল কালাম আজাদ কালিতলার ক্রিসেন্ট কিন্ডার গার্টেন স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এবং বৈবাহিক সূত্রে পাটুয়াপাড়ায় বসবাসরত হাবিবুল ইসলাম বাবুল কলেজিয়েট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে পালন করে পাটুয়াপড়ার মুখ উজ্জল করেছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : পাটুয়াপাড়ার ভিতরে প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল মাদ্রাসা ভিত্তিক। ছয় রাস্তার মোড়ে গড়ে উঠা এই মাদ্রসায় দূর-দূরান্ত হতেও শিক্ষার্থীরা পড়তে আসত। পাটুয়াপাড়া ১নং জামে মসজিদে বৃটিশ আমল থেকে বাচ্চাদের কোরাণ পড়ানো হতো। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত সাধারন শিক্ষার প্রতি এই পাড়ার ছেলে-মেয়েদের এমনকি অভিবাবকদেরও আগ্রহের ঘাটতি ছিল । তবে জলিল হাজীর বাড়ির সামনে একটি বেড়ার স্কুল দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া করানো হতো বাচ্চাদের। এই স্কুল ফয়জু পন্ডিতের পাঠশালা নামে পরিচিতি পেয়েছিল। স্কুলটির শুরু থেকে পরিচালনা করতেন ফয়জু পন্ডিত। অনেক ছাত্র-ছাত্রী ছিল। পরে স্কুলটি সরিয়ে লালবাগ নিয়ে যাওয়া হয় যা এখন লালবাগ সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত। সে হিসেবে বলা যায়, এক সময় পাটুয়াপাড়া এলাকার ভিতরে মাদ্রাসা ও স্কুল থাকলেও এখন নেই।
জলিল হাজীর বাড়ির সামনে (বর্তমানে পৈতৃক বাড়িটিতে বসবাস করছেন পুত্র রেজাউর রহমান রেজু) প্রতিষ্ঠিত বেড়ার স্কুলটিতে আছিরউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল আজিজ প্রমুখ শিক্ষকতা করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। আছিরউদ্দিন আহমেদ পরিচিত ছিলেন আছির পন্ডিত হিসেবে। আর আব্দুল আজিজ পরিচিত হয়েছিলেন মোল্লা মাষ্টার হিসেবে। মোল্লা মাষ্টার ভীষণ রাগী ছিলেন বলে শিক্ষার্থীরা তাকে ভয় পেত। কিন্তু অভিভাবকদের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল। শাসন ছাড়া পড়া হয় না এমন বিশ^াস ছিল তখনকার অভিভাবকদের। তারা কঠিন শাসনের জন্য মেজাজী মোল্লা মাষ্টার (আব্দুল আজিজ) কে পছন্দ করতেন এবং যোগ্য মনে করতেন। পরবর্তীতে স্কুলটি লালবাগ ঐলাকায় সরিয়ে নিয়ে নাম দেয়া হয় লালবাগ সরকারি মডেল প্রাইমারী স্কুল। এই স্কুল এক সময় পাটুয়াপাড়ায় ছিল এখন সেটা বোঝার উপায় নেই।
মাঠবিহীন পাড়া : পাটুয়াপাড়ায় এখন কোন মাঠ নেই। এক সময় জাগরণী ক্লাবের মাঠ হিসেবে পরিচিত বদিউজ্জামানের মাঠে কিশোর যুবকরা নানান খেলায় মত্ত থাকত। ব্যক্তি মালিকানাধীন সেই মাঠ প্লট করে বিক্রি হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে ঘর-বাড়ি। এক সময় দহলা নামের একটি মাঠ ছিল। সেই মাঠে বর্ষাকালে পানি থাকলেও অন্য সময় খেলাধুলা করা যেত। ঘুড়ি ওড়াত বহু ছেলে। এখন সেই মাঠে বাড়ি। বলতে গেলে পাটুয়াপাড়ার ছেলে- মেয়েদের খেলাধুলা ও বিনোদনের কোন জায়গা এখন নেই। তবে দুধের সাধ ঘোলে মিটাতে পাটুয়াপাড়া ঈদগাহ মাঠে ও লিচু বাগানে কিশোরদের অনেকে খেলাধুলা করে থাকে। এই দুই জায়গায় বছরে এক-দু’বার ওয়াজ মাহফিলেরও আয়োজন হয়। তবে আশংকা হলো যে, লিচু বাগানটি বেশিদিন আর ফাঁকা থাকবে না। এটা সংকুচিত হতে শুরু করেছে। আর ঈদগাহ মাঠের জায়গাটি খুব বেশি বড় নয়। এত বিশাল পাড়ার হাজারো ছেলে-মেয়ের জন্য এই মাঠ খেলাধুলার জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়।
এক সময় পাটুয়াপাড়ার বেশিরভাগ বাড়ি ছিল কোঠার বা মাটির। তখন পাকা বাড়ি গুটিকয় মাত্র। পাকিস্তান আমলে জলিল হাজী, জমির হাজী, সাহাবুদ্দিন ডিলার, গোলাম রাব্বানী ডেপুটি কমিশনার, আহসানউদ্দিন আহমেদ ওরফে খেরু সর্দার, মতিয়ার রহমান কন্ট্রাক্টর, ইউসুফ পানুয়া, নাজিরউদ্দিন হাজীর বাড়িসহ গুটি কয়েক বাড়ি পাকা ছিল। বাকি সব মাটি অথবা বেড়ার। মাটিরই বেশি। কিন্তু ১৯৬৮ ও ১৯৮৮ এর বন্যায় মাটির ও বেড়ার বাড়ি সমূহের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ায় লোকজন ইটের গাথুনি দিয়ে বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। এখন এই পাড়ার অধিকাংশ বাড়ি পাকা অথবা আধাপাকা। তবে মাটির বাড়ির কিছু নিদর্শন এখনো দেখা যায়।
পাটুয়াপাড়ায় বেশ কিছু পুকুর ছিল। জানকি বাবুর পুকুর, মোল্লা মাষ্টারের পুকুর, হাজী মনসুরের পুকুর, মহসীন চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশের পুকুর, জাগরণী ক্লাবের পুকুর, চৌধুরী ভাইয়ের পুকুরসহ আরো কয়েকটি পুকুর। এগুলোর সবই ভরাট হয়েছে। ঘর-বাড়ি নির্মাণ হয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পাটুয়াপাড়ার পুকুর এখন বিলুপ্তির পথে।
সুইহারি হতে যে গিরীজা ক্যানেলের শুরু, তা পাটুয়াপাড়ার ভিতর দিয়ে পাহাড়পুর, বালুয়াডাঙ্গা হয়ে পুনর্ভবা নদীতে গিয়ে পড়েছে। মহারাজার আমলে পয়:প্রণালী নিস্কাশনের জন্য খননকৃত এই ক্যানেল দিয়ে বন্যার পানি সহজে নদীতে চলে যেত। এখন ক্যানেলটি ভরাট প্রায়। ক্যানেল পানি টানতে পারে না, তাই সামান্য বৃষ্টি হলেও পাটুয়াপাড়ার অনেক বাড়িতে হাটু পানি জমে যায়। বর্তমান লিচু বাগানের কাছে জনতা ফার্মেসীর মালিকের বাড়ির কাছে একটি ছোট দাঁড়া ছিল। এক সময় লোকে সেখানে প্রতিদিন হাগু করত। সেই দাঁড়াটি ভরাট করে ঘর-বাড়ি তোলা হয়েছে।
রাজনৈতিক সক্রিয়তা : নেতৃত্বে পিছিয়ে থাকলেও পাটুয়াপাড়ার লোকজনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা আছে বৃটিশ শাসনাামল থেকেই। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হওয়া না হওয়ার যে রাজনীতি তাতে পাটুয়াপাড়ার প্রায় সর্বশ্রেণীর লোক পাকিস্তান হওয়ার পক্ষে ছিলেন। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগানযুক্ত মিছিলে পাটুয়াপাড়ার আহসানউদ্দিন আহমেদ, দাবা তমিজ, ডা. মফিজউদ্দিন, নহরউদ্দিন আহমেদ, হাজী জলিল, হাজী জমির, আব্দুল হামিদ, আব্দুল আজিজ ওরফে মোল্লা মাষ্টার, ইউসুফ পানুয়া, মজিরউদ্দিন পানুয়াসহ আরো অনেকের অংশগ্রহণ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের সময় বর্তমান মহসীন চেয়ারম্যানের বাড়ি ও হাফিজউদ্দিন হাফুর বাড়ি সামনের খোলা জায়গা থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে প্রায় প্রতিদিনই মিছিল বের হয়েছে। যেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় সেদিন যুব-কিশোররা আনন্দ মিছিল বের করেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির দিন (১৪ আগষ্ট, ১৯৪৭) একাডেমি স্কুল হতে একটি আনন্দ মিছিল বের করা হয়েছিল যার সম্মুখভাগে পাকিস্তানি পতাকা বহন করেছিলেন ভূষণ নামের এক যুবক যার বাড়ি ছিল পাটুয়াপাড়ায়। লোকে তাকে ভূষণ পাগলা বলে ডাকতেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ও পরে পাটুয়াপাড়ার বেশিরভাগ লোক ছিলেন মুসলিম লীগ সমর্থক। আলহাজ¦ জলিলউদ্দিন জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ইউসুফ আলী পানুয়াও ছিলেন মুসলিম লীগের বড় নেতা। তাদের কিছু সমর্থক মাস্তান হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৫৪ সালের বেসিক ডেমোক্রেসি নির্বাচনে তখনকার জাঁদরেল এই দুই নেতা দুই পক্ষের হয়ে নির্বাচন করেছিলেন। আইয়ুব খান সমর্থিত মুসলিম লীগ প্রার্থী জলিল কন্ট্রাক্টর বটগাছ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হন। আর ফাতেমা জিন্নাহ সমর্থিত কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রার্থী ইউসুফ আলী গোলাপ ফুল মার্কায় হেরে যান। নির্বাচনে পাটুয়াপাড়া, মুদিপাড়া, ক্ষেত্রিপাড়া, ইনায়েতপুরের ভোটারদের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল ছয় রাস্তা মোড়ের একটি মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসায় বহু দূর-দূরান্ত হতে ছেলেরা হাদীস ও পবিত্র কোরান পড়তে আসতেন। মাটির ঘর যুক্ত এই মাদ্রাসা বর্তমানে নেই। ভোট গ্রহণের দিন কারচুপি হওয়ার অভিযোগ পেয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগের একটি মিছিল ভোট কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে এলে ব্যাপক হট্টগোল হয়। মিছিলটির উপর মুসলিম লীগ সমর্থকরা ধারালো অস্ত্রসহকারে হামলা চালায় ও মোজাম্মেল হক নামের এক যুবক ছুরিকাহত হয়ে মারা যায়। তার বাড়ি ছিল দিনাজপুর সদরের শশরা ইউনিয়নে। দিনাজপুর জেলায় রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি ছিলেন এই মোজাম্মেল হক যা পাটুয়াপাড়ার ছয় রাস্তা মোড়ে সংঘটিত হয়েছিল।
সেই সময় ভোট গ্রহণের পদ্ধতি এখনকার মত ছিল না। এখন একটি ব্যালট বাক্সের মধ্যে ভোটাররা তার ব্যালট ঢুকিয়ে দেন, ভোট তিনি যে মার্কাতেই দিন না কেন। কিন্তু তখন প্রতিটি মার্কার জন্য আলাদা আলাদ ব্যালট বাক্স ছিল। যে প্রার্থী যেই মার্কায় ভোট দিতেন, তিনি সেই ব্যালট পোপারটি ঐ মার্কার ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দিতেন। এর ফলে তখন ভোটারের গোপনীয়তা সংরক্ষিত থাকত না। কোন মার্কায় ভোট দিলেন তা সবাই জেনে যেতেন। সেদিন খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আইয়ুব খানের প্রার্থী হেরে গেলেও জোর করে তার ব্যালটে সিল মারানো হচ্ছে। জবরদস্তি সিল মারার ঘটনা প্রতিহত করতে এসেই ছুরিকাহত হন মোজাম্মেল।

পাটুয়াপাড়ার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া গিরীজা
ক্যানেল এখন পারি ধারণ করতে পারছে না।

জলিল হাজী পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। লোকে তাকে সম্মান করতেন। প্রশাসনের লোকেরাও যে কোন বিষয়ে তাকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের দালালী করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এই কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার প্রভাব কমে যায় এবং গুরুত্বহীন ব্যক্তিতে পরিণত হন। এর উল্টোদিকে গুরত্ব বাড়ে মহসীন আলীর। প্রথম থেকেই যুবকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন তিনি। স্বাধীনতার পর রিলিফ চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং দিনাজপুর পৌরসভায় ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে দ্ইু দফায় বিপুল ভোটে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর মহসীন আলী বিএনপিতে যোগ দেন এবং দিনাজপুর জেলা বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার বাসভবনে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজাসহ অনেক গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি এসেছেন। সাবেক স্পীকার ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ব্যারিষ্টার জমিরউদ্দন সরকার পাটুয়াপাড়ার জলিল হাজির জামাতা। তিনি তার শ^শুরবাড়িতে বেশ ক’বার এসেছেন বলে জানা যায়।
ভাষা আন্দোলনে পাটুয়াপাড়ার লোকজনের অংশগ্রহণ ছিল। জসিরউদ্দিন ভাদু ছিলেন ঐ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে রফিক, সালাম, বরকত জব্বার হত্যার প্রতিবাদে দিনাজপুরে যে প্রতিবাদী মিছিল হয়েছিল তাতে পাটুয়াপাড়ার অনেকে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। লালবাগের বামপন্থী ছাত্রনেতা জাফর, জোহাক, জয়নালের রাজনৈতিক প্রভাব দেখা যায় পাটুয়াপাড়ায়। কমিউনিষ্ট নেতা গুরুদাস তালুকদার, মকবুল আহমেদ হেনার প্রভাবও ছিল। তাদের প্রভাবে হাসিম আলী, মো. মোস্তাকিম, বুলবুল, রেজাউল ইসলাম, রেজাউর রহমান রেজু, নুরুল মতিন সৈকত প্রমুখ বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়নে সক্রিয় থাকেন। এক সময়ের কমিউনিষ্ট নেতা মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর প্রভাব ছিল পাটুয়াপাড়ায়। তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে হাফিজউদ্দিন আহমেদসহ অনেকেই কমিউনিষ্ট পার্টি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে সম্পৃক্ত থাকেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাটুয়াপাড়ায় আওয়ামী রাজনীতির সাথে হাফিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন। নুরুন নবী রবি আওয়ামী লীগের সাথে জড়িয়ে আছেন স্বাধীনতার পর থেকেই। ষাটের দশকে বোদার সিরাজুল ইসলামের প্রভাবে ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিলেন গোলাম মজিদ বুলবুল। তিনি পঞ্চগড়ে ছাত্রলীগের কমিটি করতেও গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রæপে জড়িয়ে পড়েন। আশির দশকে আজহারুল আজাদ জুয়েল, আকরাম আলী খান বাবলা, মর্তুজা হায়দার লিটন ছাত্রলীগে নেতৃত্ব দিলেও এখন কেউই সরাসরি রাজনীতিতে নেই। মর্তুজা হায়দার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। রেজাউর রহমান রেজু ছাত্র ইউনিয়ন ও যুব ইউনিয়নে নেতৃত্ব দিয়ে জেলা পর্যায়ের বলিষ্ঠ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। নারীদের মধ্যে কানিজ রহমান ও মারুফা বেগমের উত্থান পাটুয়াপাড়ার জন্য গর্বের বিষয়। তারা মহিলা পরিষদের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক হয়ে জেলা পর্যায়ে নারী সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এক সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াত। পাটুয়াপাড়ার ফিরুজুল আলম, জয়নাল আবেদীন মানিক, ইসমাইল হোসেন পল্টু এই দলে সক্রিয় ছিলেন। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর দাপটও দেখা গেছে এক সময়। পাটুয়াপাড়ার শামসুল আলম, মকবুল হোসেন, সাবুল এই ছাত্র সংগঠনটির সাথে যুক্ত ছিলেন। গোপাল দাস নামের একজন এক সময় জাগপা করলেও পরে আওয়ামী লীগে সম্পৃক্ত হন।
জনপ্রতিনিধিত্ব : পাটুয়াপাড়ার ভিতর থেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বৃটিশ আমলে একজন, পাকিস্তান আমলে একজন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৪৯ বছরে মাত্র দুইজনকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। পাটুয়াপাড়ার বাসিন্দা গোলাম রব্বানী আহমেদ বৃটিশ সরকারের অধীনে স্কুল পরিদর্শক ছিলেন। এলাকার লোকের কাছে ‘ডেপুটি রাব্বানী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত একটি উপনির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। রাজনীতি করলেও এলাকার লোকজনের সাথে তেমন মেলামেশা তার ছিল না। তিনি ১৯৬১ সালে মৃত্যু বরণ করেন। পাটুয়াপাড়ার মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অবিভক্ত ভারতের বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। পাটুয়াপাড়ার অতি পরিচিত মুখ হাজী জলিল ১৯৫৪ সালে আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি সিস্টেমের নির্বাচনে দিনাজপুর পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। দিনাজপুর পৌরসভায় একবার ভাইস চেয়ারম্যান ও দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে পাটুয়াপাড়াকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন মহসীন আলী। তার মৃত্যুর পর আর কেউ চেয়ারম্যান হতে পারেন নাই। তার ছোট ভাই রেজাউল ইসলাম একবার চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য নির্বাচন করেছিলেন। তবে সুবিধা করতে পারেন নাই। পাটুয়াপাড়ার আরেকজন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন রায়হান আলী খান তাজ। তিনি দিনাজপুর পৌরসভায় দুইবার কমিশনার হয়েছিলেন।

পাটুয়াপাড়ায় কোঠার বাড়ির নিদর্শন এখনো আছে।

সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা : সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতায় পাটুয়াপাড়ার অবস্থা একবারেই খারাপ নয়। বৃটিশ শাসনামলে পাটুয়াপাড়ার একজন চারণ কবি ছিলেন আমিরুদ্দিন চৌধুরী। কবিগানের গায়ক ছিলেন। ১০-১৫ পৃষ্ঠার মধ্যে শতাধিক কবিতা পুস্তকের রচয়িতাও তিনি। আশির দশকে নিজ বাসায় বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয় তার। ত্রিশ-চল্লিশ দশকের সুকন্ঠী গায়ক নুরুল ইসলাম ছিলেন তারই যোগ্য পুত্র।
পাটুয়াপাড়ার মহসীন আলী একমাত্র ব্যক্তি যিনি একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। নাম আজকের প্রতিভা। তিনি পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আবু সাঈদ কুমার প্রকাশক-সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করে যাচ্ছেন।
এই পাড়ার দুইজন লেখক-সাংবাদিক ও কলামিস্ট হলেন আজহারুল আজাদ জুয়েল ও হামিদুল হক টিপু। হামিদুল হক দিনাজপুর কলামিষ্ট এসোসিয়েশনের এবং আজহারুল আজাদ জুয়েল দিনাজপুর লেখক ফোরামের সাধারন সম্পাদক। পাটুয়াপাড়ার আরো দুইজন নুরুল মতিন সৈকত ও মামুনুর রহমান জুয়েল লেখা-লেখিতে পরিচিতি পেয়েছেন। মারুফা বেগম, রেজাউর রহমান রেজু মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছেন। লেখালেখি করে সাংবাদিকতায় এসেছিলেন মর্তুজা হায়দার লিটন। এখন তিনি ঢাকায় ফুলটাইম সাংবাদিকতায় যুক্ত আছেন।
আবু তাহের বর্ধমানী যিনি একজন মাওলানা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সারা বাংলাদেশে। ধর্মীয় বিষয়ে বেশ কিছু বই লিখেছিলেন যার মধ্যে আলোচিত ছিল ‘উল্টা বুঝিল রাম’ বইটি। আকরাম আলী খান ১৯৮০ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেল হতে সাহিত্য, ম্যাগাজিন ও বিতর্ক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার সম্পাদনায় সরকারি কলেজ বার্ষিকী ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
ওস্তাদ কসিরউদ্দিন ছিলেন দিনাজপুরের প্রখ্যাত তবলাবাদক, যার পরিচিতি পুরো বাংলাদেশে ছিল। মকছেদ আলী বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী। টেলিভিশনে গান গেয়েছেন নুরুল মতিন সৈকত। আল বেরুনী গানের সূত্র ধরে প্রখ্যাত কন্ঠ শিল্পী শুভ্র দে’র সাথে মডেলিং করেছেন। খায়রুজ্জামান রাজা সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে অনেক ছেলে- মেয়েকে তালিম দিয়েছেন। হীরা গান গেয়েই যুক্তরাজ্য প্রবাসী হয়েছেন। আবু সাঈদ কন্ঠ শিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, দিনাজপুর শাখার সাধারন সম্পাদক ছিরেন। চিত্রাংকনে সফল ব্যক্তিত্ব ছিলেন বাম রাজনীতির মো. মোস্তাকিম। চিত্রাংকনকে পেশা হিসেবে নিয়ে স্কুল খুলেছেন রানা।
রেজাউর রহমান রেজু বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সফল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু বিশ^জুড়ে কমিউনিজমের বিপর্যয়ের পর রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন। তিনি উদীচীর জেলা কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে সাধারন সম্পাদক হিসেবে দিনাজপুর নাট্য সমিতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নূরুল মতিন সৈকত মণিমেলা প্রতিষ্ঠা করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, দিনাজপুর এর সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিতার-টিভি শিল্পীদের নিয়ে দিনাজপুর বেতার-টিভি শিল্পী পরিষদ গঠন করেছেন মকছেদ আলী। এই পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

পাটুয়াপাড়ার প্রবীণ ব্যক্তিদের একজন
আলহাজ¦ ইয়াকুব আলী (৮৫)।

পাটুয়াপাড়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য : পাটুয়াপাড়ায় এক সময় সর্দার প্রথা প্রচলিত ছিল। যারা যেই মসজিদে নামাজ পড়তেন তারা সেই মসজিদের মোতয়াল্লীকে সর্দার মানতেন। তবে বড় ধরণের সমস্যা সমাধোনের ক্ষেত্রে পাটুয়াপাড়া ১ নম্বর জামে মসজিদের মোতয়াল্লী থাকতেন সবার উপরে। এই মসজিদের মোতয়াল্লী হিসেবে খেরু সর্দার এবং তার মৃত্যুর পর মহসীন আলী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। এলাকার যে কোন বিষয়ে তারা যে অভিমত দিতেন সাদারনত সবাই সেটা মেনে নিতেন। তবে এখন সর্দারী প্রথা আর কার্যকর নেই।
পাটুয়াপাড়ায় কখনো ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায় নাই। তবে যখন অধিকাংশ মাটির বাড়ি ছিল, সেই সময় দু-একটা চুরির ঘটনা কিংবা সিঁধেল চুরি সংঘটিত হয়েছে। এরও পরিমাণ কম। সাধারনত চোরেরা পাটুয়াপাড়ায় চুরি করার সাহস দেখাত না। ধরা পড়লেই বিপদ হতো। গণপিটুনির শিকার হতে হতো। বিশেষ করে আশরাফুল আলম, আব্দুল হান্নানদের হাতে চোর পড়লে বাঁশদলা খেতে হতো। চোর বলত থানায় দেন। কিন্তু তারা বলতেন, আগে মাইর, তারপর থানা। মাইরটা এমন হতো যে, চোরের আর সাহস হতো না পাটুয়াপাড়ায় ঢোকার। ফলে চুরির ঘটনা এই পাড়ায় কম ছিল এবং এখনো কম রয়েছে।
বিশেষ ব্যক্তিত্ব : মহসীন আলী পাটুয়াপাড়ার একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। তিনি জনপ্রতিনিধি, সংবাদপত্রের প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। এলাকার দরিদ্র মেয়েদের শিক্ষার স্বার্থে ওয়াজিফা সামাদ বালিকা বিদ্যালয় এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য সুইড বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় দিনাজপুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় (পূর্ব নাম মানসিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ ও শিক্ষা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। পাটুয়াপাড়ায় হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও তার। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি ও ডা. আব্দুল আজিজ সাধারন সম্পাদক ছিলেন।
স্বর্ণকার আব্দুল জব্বারের পিতা আলিমউদ্দিন ছিলেন পরহেজগারী। এক ধরণের দরবেশী ভাব ছিল তার। প্রতি রমজানের শেষ ১০দিন মসজিদে কাটাতেন প্রতি বছর। মসজিদে নামাজ-বন্দেগী রাত যাপন ও খাওয়া করতেন। এই ক’দিন তিনি মসজিদের বাইরে আসতেন না। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল অস্বাভাবিক রাগ। তার একটি চাবুক ছিল, রেগে গেলে ঐ চাবুক গাছের উপর চালাতেন। তার আরেকটি বৈশিষ্ঠ্য হলো কাউকে ডাকলে পুরো নাম ধরে ডাকা। যেমন কারো নাম যদি মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম হয় তাহলে পুরো নাম ধরেই ডাকতেন, শুধু ‘আমিনুল’ বলে ডাকতেন না। তিনি তার নিজের স্ত্রীকে ডাকতেন সন্তানদের সকলের নামের শেষে মা যুক্ত করে এভাবে “কইগো মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদআব্দুস সাত্তার, মোসাম্মৎ আহেলা খাতুন, মোসাম্মৎ সালেহা খাতুনের মা?’
পাটুয়াপাড়ার হোমিও চিকিৎসক আব্দুল আজিজের পরিচিতি ছিল মোল্লা মাষ্টার হিসেবে। যদিও তার নাম মোল্লা ছিল না কিন্তু এলাকায় ঐ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। ছোট থেকে মাথা টুপি পড়ে থাকার কারণে তার এই পরিচিতি। তিনি চিকিৎসা পেশায় আসার আগে শিক্ষকতা করেছিলেন এবং অংক খুব ভাল বোঝাতে পারতেন। পড়া না পারলে ছাত্র-ছাত্রীদের বেদম মারতেন। তার রাগের কথা এখনো পাটুয়াপাড়ায় অনেকের মুখে মুখে রয়েছে।
আব্দুর রশিদ ছিলেন মারবেল খেলোয়াড়দের জন্য ভয়ংকর ব্যক্তি। তিনি পাটুয়াপাড়ার ভেতরে কাউকে মারবেল খেলতে দেখলেই তা ধাওয়া দিয়ে কেড়ে পুকুরে, নর্দমায় ফেলে দিতেন। স্কুলের সময় মারবেল পছন্দ করতেন না। তিনি তাছাড়া মারবেল খেলাকে জুয়া বলেও মনে করতেন।
রবিউল, লাল, বেলার বাবা মংলু দরজিগীরী করতেন। অন্যদের সাথে তার পার্থক্য হলো যে, তিনি পাটুয়াপাড়ার প্রায় সকল লাশের কাফন সেলাই করতেন। তার জীবদ্দশায় এই পাড়ার যারা মারা গেছেন তাদের প্রায় সকলের লাশের কাফন বানিয়েছেন তিনি। পাটুয়াপাড়ার আরেকজন বিশে ব্যক্তিত্ব হলেন মীর মাহবুব। তিনি প্রায় সকল লাশের গোসল করিয়েছেন এবং এখনো করছেন।
পীরতত্ব : পাটুয়াপাড়ার মানুষ সাধারনভাবে ধর্মভীরু। বলা যায় সবাই কম-বেশি নামাজ বন্দেগী করে থাকেন। এই পাড়ায় মোট ৫টি মসজিদ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন পাটুয়াপাড়া ১ নম্বর জামে মসজিদ চতুর্দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কয়েক বছর আগে এই মসজিদের পুরাতন ভবন যা চুন-সুরকির গাঁথুনিতে ছোট্ট ছোট্ট ইট দ্বারা তৈরী ছিল সেই ভবন ভেঙ্গে নতুন আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর পরের প্রাচীনতম ছয় রাস্তা মোড় জামে মসজিদটি। ঐ মসজিদ প্রায় শতবর্ষের। এরপর আছে পাটুয়াপাড়ার ২নং জামে মসজিদ। তারপর বাংলালিংক টাওয়ার সংলগ্ন মসজিদ। তারপর পাটুয়াপাড়ার পশ্চিমে জানকি মজুমদারের পুকুরের কাছাকাছি গড়ে উঠা মসজিদ।
পাটুয়াপাড়ায় এক সময় পীর সাহেবদেরও বসবাস ছিল। মজিল ফকির পীর সাহেবের আস্তানায় পাকিস্তান আমলে ওরস শরীফ হতো জাঁকজমকপুর্ণ ভাবে। প্রতি বছর ১১ ও ১২ চাঁদে ওরস শরীফে বহু লোকের খানাপিনা হতো। বিশেষ ধরণের ফ্লাগ বা পাতাকা লাগিয়ে ওরস শরীফকে বর্ণাঢ়্য রুপ দেয়া হতো। তাঁর অসংখ্য মুরিদ ছিল। তারর পিতার নাম ছিল আলী খলিফা। তিনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। আমি ( লেখক) যখন একেবারেই ছোট সেই সময় মজিল ফকিরের ওরস শরীফের দাওয়াত খেতে গিয়ে ছাইচাপা জ¦লন্ত চুলায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার বড় ভাই আবুল কালাম াাজাদ বাবলু এক ঝটকায় টেনে না তুললে পুড়েই মারা যেতাম। এরপরেও আমার উড়– ও পায়ের চামড়া অনেকটাই পুড়ে গিয়েছিল এবং তিন-চার মাস ভয়ংকর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাটুয়াপাড়ার সকল মানুষের কম-বেশি অংশগ্রহণ ছিল। বিশেষ করে যুব শ্রেণীর সবাই তখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথমবারের মত পাটুয়াপাড়ায় হামলা চালায় এবং গুলিবর্ষণ ও অগ্নি সংযোগ করে। পাটুয়াপাড়া ২নং জামে মসজিদ সংলগ্ন একটি টেলিফোন পোলে এখনো সেদিনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন রয়ে গেছে। সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের আগমন ঠেকাতে পাটুয়াপাড়ার যুবকরা বর্তমান পাটুয়াপাড়া ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন ব্রীজটি ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্ত্র ব্রিজ ভাঙ্গার কাজ শুরুর মুহর্তে হানাদার বাহিনী সেখানে চলে আসে এবং গুলি বর্ষণ করে। সৌভাগ্য বশত ঐ গুলি কাউকে লাগে নাই। সেদিন ২০-২২ জন যুবক ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন খসড়া আজিজুলের বাড়িতে লুকিয়ে প্রান রক্ষা করেন। পাকিস্তানি হানাদাররা যদি টের পেতেন যে, ঐ বাড়িতে যুবক ছেলেরা লুকিয়েছে অথবা তারা যদি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেন তাহলে সেদিন মহা-সর্বনাশ হতো। সেনারা সেদিন সফিউদ্দীন আহমেদ ওরফে সফি লাঠিয়ালের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে পুরো বাড়ি পুড়ে গিয়ে ধ্বংস হয় এবং দুইটি গরু মারা যায়। এই সময় পাটুয়াপাড়া জাগরণী ক্লাবেও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে পাটুয়াপাড়ার বেশ ক’জন শহিদ হয়েছেন। একজন বৃদ্ধাকে তার বাড়িতেই বিহারিরা হত্যা করেছিল। তিনি হলেন মহসীন চেয়ারম্যানের ভগ্নীপতি আব্দুল মান্নানের মা মাহিজান নেছা। অন্যেরা হানাদারদের হাতে শহিদ হন পাটুয়াপাড়ার বাইরে। যেমন ইয়াকুব হাজী ও বারেক-খালেকের পিতা নহরউদ্দিন বুড়া পুনর্ভবা নদী পেরিয়ে বিরলে যাওয়ার পথে হত্যার শিকার হয়েছিলেন। একইভাবে হত্যার শিকার হন পাটুয়াপাড়ার অতি পরিচিত মুখ শাহাবুদ্দিন ডিলার। নদী পার হওয়ার সময় তাকে দূর থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। মো. ইসমাইল হোসেন পল্টু ছিলেন পাটুয়াপাড়া জাগরণী ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী। তিনি ক্লাব মাঠে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পিটি করাতেন। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে কি না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার খবর নিতেন এবং স্কুলে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। একাত্তরে তাকে মাঝাডাঙ্গা এলাকা হতে আটক করার পর গায়ে আগুনের ছেঁকা দেয়া হয়। ভিষণ নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়।
পাটুয়াপাড়ার প্রখ্যাত শিক্ষক জবেদ মাষ্টারের সহদোর ছিলেন আব্দুল জলিল, যিনি খোচা জলিল নামে পরিচিত ছিলেন এবং কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী ধরণের ছিলেন। তাকে গ্রাম এলাকায় হত্যা করা হয়। রেজিয়া সোপ ফ্যাক্টরীর প্রতিষ্ঠাতা নাজিরউদ্দিন আহমেদের পুত্র মকবুল হোসেনকে হত্যা করা হয় আদর্শ কলেজের সামনের একটি আমবাগানে। বর্তমানে বাগান কেটে বাড়ি-ঘর করা হয়েছে। এই বাগানে বিহারিরা তাকে হত্যা করেছিল বলে জানা যায়। আসাদুর ও মিজানুর রহমান মিজু ছিলেন আপন সহদোর, পাটুয়াপাড়ার প্রখ্যাত দুই শিক্ষক হেমায়েত আলী ও সাইফুর রহমানের ভাই ছিলেন তারা। তাদেরকে একাত্তরে হত্যা করা হয়েছিল গ্রাম এলাকায়।
পাটুয়াপাড়ার সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার পাশাপাশি অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরাসরি সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। সরকার স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণ হলেন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাবলু পিতা-মৃত ডা. আব্দুল আজিজ, মো. নজরুল ইসলাম পিতা-মৃত মো. রোস্তম আলী, মো. আজাহার আলী পিতা-মৃত মো. সোলাইমান আলী, মো. হাসিম আলী পিতা-মৃত আলহাজ¦ মো. জাফর আলী, শাহ মো. আব্দুল হান্নান পিতা-মৃত শাহ মো. মেহেরুল্লাহ, মো. হাবিবুর রহমান পিতামৃত সোলেমান মিঞা, মো. নুরুল ইসলাম মাতু পিতা-মৃত আশু মোহাম্মদ, মো. মোজাফফর রহমান পিতা-মৃত কছিরউদ্দিন আহমেদ, মো. আশরাফুল আলম পিতা-মৃত আশু মোহাম্মদ, মো. শামসুল আলম পিতা-ইসলামউদ্দিন মিঠু, মো. রেজাউল ইসলাম পিতা-মৃত আলহাজ¦ আহসানউদ্দিন আহমেদ।

করোনাকালে ৯৭ বছর বয়সে মারা গেলেন


লাঠিয়াল সফিউদ্দিন আহম্মেদ সফি।

লাঠিয়াল : পাটুয়াপাড়ার কিছু লোক এক সময় লাঠি খেলা জানতেন। তারা সাহসী এবং পরিচিত ছিলেন। লুৎফর রহমান পাটুয়াপাড়ার প্রখ্যাত লাঠিয়াল। কথিত আছে যে, তিনি এমনভাবে লাঠি ঘুরাতে পারতেন যে, তার দিকে একসাথে অনেকগুলো মারবেল ছুঁড়ে মারলেও মারবেল তাকে স্পর্শ করতে পারত না। লাঠি ঘুরিয়ে সব মারবেল প্রতিহত করতে পারতেন। তিনি বলতেন, আমার দিকে গুলি করা হলেও লাঠি দিয়ে গুলি প্রতিহত করতে পারব। তার সম্পর্কে জানা যায় যে, যুব বয়সে বড়বন্দর এলাকায় কিছু ছেলে একবার তাকে বেদম মার মেরেছিল। এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে একজন লাঠিয়াল কর্তৃক লাঠি খেলা শিখে নিয়েছিলেন। এরপর রেলবাজার হাট এলাকায় একবার মারামারির ঘটনা ঘটলে একাই লাঠি ঘুরিয়ে পুরো হাট ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তার লাঠির আগাত থেকে বাঁচতে হাজার হাজার লোক সেদিন হাট ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তিনি এবং ভুকু নামের একজন লাঠিয়াল পাটুয়াপাড়াসহ অন্য পাড়ার অনেক যুবককে লাঠি খেলা শিখিয়েছেন। পাটুয়াপাড়ায় আরো লাঠিয়াল ছিলেন সফিউদ্দিন আহম্মেদ, মন্টু, সুলতান প্রমুখ। সফিউদ্দিন আহমেদ বালুবাড়ির মহি, মাইনু, ফজলুর কাছে লাঠি খেলা শিখেছিলেন। বিহারিদের মহররমের অনুষ্ঠানে তারা লাঠিখেলা প্রদর্শন করতেন। সাহসী হওয়ার কারণে মন্টু ও সুলতানকে লোকে মন্টু গুন্ডা এবং সুলতান গুন্ডা হিসেবে চিনতেন। পাটুয়াপাড়ার আরো কয়েকজন সাহসী লোকের নাম পাওয়া যায় যারা পাড়ার বিপদে এগিয়ে আসতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ কারা যায় রেজাউল ইসলাম, শাহ আব্দুল হান্নান, আশরাফুল আলম, আশরাফুল আলম কারী, নাজমুল ইসলাম, নুরউদ্দিন প্রমুখ।
ক্লাব প্রতিষ্ঠা : পাটুয়াপাড়ায় জাগরণী ক্লাব নামের একটি ক্লাব রয়েছে। যুব সমাজের মানস গঠণের লক্ষ্যে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন ক্লাবের নাম দেয়া হয়েছিল বনপথ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর আইয়ুব খানের শাসনামলে নাম পরিবর্তন করে জাগরণী ক্লাব রাখা হয়। নামকরণ করেছিলেন মুনলাইট ইলেকট্রোনিক্স এর মালিক শাহাবদ্দিনের ভাই মো. শরিফ উদ্দিন। ক্লাব প্রতিষ্ঠায় শহিদ ইসমাইল হোসেন পল্টু, জবায়দুর রহমানের পিতা আব্দুল জব্বার, মহসীন আলী ও তার ছোট ভাই আব্দুর মান্নান, শফি লাঠিয়াল, মন্টু গুন্ডা, লাঠিয়ালমতিয়ার রহমান, খায়রুল আনম, লুৎফর রহমান, পাকু, হাফিজউদ্দিন আহমেদ হাফু, নবী, জলিল মিয়া, আনোয়া হোসেন, মহি পানুয়ার বড় ছেলে শহিদুল প্রমুখের অবদান আছে।
জাগরণী ক্লাবের মাধ্যমে এক সময়ে ক্রীড়াজগতে পাটুয়াপাড়ার ছেলে-মেয়েরা ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন। অনেক ফুটবলার গড়ে উঠেছিল যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শাহিন তাজু, মানিকসহ অনেকে। সাইক্লিংয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন রেজু, জাহাঙ্গীর আলম ছানা, সাইদুর প্রমুখ ভাল করেছিলেন। দাবা খেলায় রকেট, জকেটসহ আরো অনেকের সুনাম ছিল। পাটুয়াপাড়ার মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন। দু-একজন ক্রিকেটারও তৈরী হয়েছিল। কিন্তু জাগরণী ক্লাব ও পাটুয়াপাড়ার সেই ঐতিহ্য এখন শুধুই যেন স্বপ্ন।
কাফেলা : রমজান মাসে ভোর বেলা সেহরী খেতে লোকজনকে জাগিয়ে তোলার জন্য এক সময় কাফেলা বের করার প্রচলন ছিল। পাড়ায় পাড়ায় যুবকরা কাফেলা বের করতেন। কাফেলায় মাইক লাগিয়ে ইসলামি সংগীত পরিবেশন করা হতো। পাটুয়াপাড়ার কাফেলা থেকে গান পরিবেশন করতেন হাসিম আলী, আব্দুল মান্নান, হান্নান শাহ, মেহেবুর, হাসেন আলী, খায়রুজ্জামান রাজা প্রমুখ। গান লিখতেন আব্দুল কাদের, আব্দুস সাত্তার মন্টু।
আমি ও পাটুয়াপাড়া : জন্মসূত্রে পাটুয়াপাড়ার বাসিন্দা আমি (লেখক)। এই পাড়ায় আমাদের বাড়ির জায়গাটি কিনেছিলেন দাদা মরহুম আব্দুল কুদ্দুস মিয়া। তাকে দেখিনি, জমির দলিলে শুধু নাম পড়েছি। তিনি চকবাজারে মুদি ব্যবসা করতেন। পাটুয়াপাড়ায় আসার আগে থাকতেন বালুবাড়ি সুইপার কলোনীর কাছে। সুইপারদের পালিত শুকর যখন-তখন লোকজনের বাড়ি-ঘরে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করত। কাঁচা পায়খানায় গিয়ে মল ওলট-পালট করে দিয়ে সবখানে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে দিত। সে এক বিশ্রি অবস্থা। এর থেকে মুক্তি পেতে দাদা তার বালুবাড়ির জায়গা বিক্রি করে পাটুয়াপাড়ায় জায়গা কিনেছেন বলে আমার ধারণা। জায়গার পরিমান ৪৮ শতক। তিনি একজনের মৃত্যুর পর আরেকজনকে, এভাবে তিনটি বিয়ে করেছিলেন।
দাদার প্রথম স্ত্রীর সন্তান ছিলেন ফতেজান ফুফু। আমার বাবা ও মা তাকে ‘ফতে বু’ বলে ডাকতেন। তার সাথে বিয়ে হয়েছিল রামনগরের প্রখ্যাত পান ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক ওরফে মালেক পানুয়ার। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান ছিলেন আব্দুল হামিদ, যিনি দিনাজপুর জেলা জজকোর্টের একজন পিয়ন ছিলেন। দাদার তৃতীয় স্ত্রী, যিনি আমার নিজের দাদী ছিলেন, তার নাম নূরজাহান বেগম। তাকে দেখেছি। নূর অর্থাৎ আলোর মতই সুন্দর ছিলেন তিনি। তার দুই সন্তানের একজন হলেন আমার বাবা ডাঃ আব্দুল আজিজ আহমেদ এবং ছোট ফুফু মরিয়ম বেগম। লালবাগের ভোদো নামে পরিচিত এক হোটেল ব্যবসায়ীর সাথে ছোট ফুপুর বিয়ে হয়েছিল।
ছোট বেলায় পাটুয়াপাড়াকে যে অবস্থায় দেখেছি এখন তা বদলে গেছে। তখন পাটুয়াপাড়ার ভিতরে বেশ ক’টি বড় আম বাগান ছিল। সবচেয়ে বড় বাগানটি দহলার মাঠ থেকে শুরু হয়ে লালবাগের রাস্তা পর্যন্ত গিয়েছিল। বর্তমান লিচু বাগানটি আম বাগানের সাথে সংযুক্ত ছিল। আবার সুলতান গুন্ডার বাড়ির সামনে এখনো যে আম গাছগুলো দেখা যায় সেগুলিও যুক্ত ছিল। সব মিলিয়ে বিশাল এক আম বাগান। বৃটিশের সময় এই বিশাল আম বাগানের বৃহত্তম অংশের মালিক ছিলেন মহারাজার কর্মচারী যোগেন্দ্রনাথ মজুমদার, তিনি জানকি মজুমদার নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তার নামে একটি পুকুর এখনো আছে পাটুয়াপাড়ায়, জানকি মজুমদারের পুকুর। তার বাগানটি বিভিন্ন জনের কাছে হাত বদল হয়ে আতাউর রহমান, ওলিউর রহমান, টুরু মিয়া প্রমুখের মালিকানায় এসেছিল। সেই বাগান কেটে এখন বহু ঘর-বাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে।
বর্তমানে আমি যে বাড়িতে বসবাস করছি তার আশে পাশে ১০-১২টি আম গাছ নিয়ে বাগান গড়ে উঠেছিল। বৃন্দাবন, আশি^নিয়া, ফজলী, মিশ্রিভোগ, গোপালভোগ,গুটি, ভাদোরিয়াসহ বিভিন্ন নামের আম গাছ। এর কোনটা আমাদের, কোনটা বড় আব্বাদের, কোনটা মহি দারোগার, কোনটা রসুল বক্সের। সকলের গাছগুলো নিয়ে একটি বড় বাগানের মত মনে হতো। এখন সেই বাগান কেটে ঘর-বাড়ি করা হয়েছে। লোক যত বাড়ছে, ততই বাগান কাটা হচ্ছে। মহসীন চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ইউসুফ পানুয়ার বাড়ি পর্যন্ত পুরো জায়গাটি আম গাছে ভর্তি ছিল। সেই বাগানও এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। পাটুয়াপাড়ার পশ্চিমের শেষ প্রান্তে জমির হাজী ও জলিল হাজীর বাগান ছিল। সেই বাগানও এখন বিলুপ্তির খাতায়। সব বাগানেই এখন ঘর আর বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রধান রাস্তায় যাওয়ার একটা মেঠো পথ ছিল। সেই পথের মাঝামাঝিতে একটি তালগাছ ছিল। এটা পাটুয়াপাড়ার একমাত্র তালগাছ ছিল তাল যেখানে সেই বাবুই পাখির অনেক বাসা দেখা যেত। গাছের চতুর্দিকে আম লিচুর গাছ এবং অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল। ঐ জায়গার মালিক ছিলেন খাদেমুল কন্ট্রাকটর। কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গা, আম গাছ, লিচু গাছ এখন নেই। একমাত্র তালগাছটিও নেই। পুরোটা ঘর-বাড়িতে ভরাট হয়ে গেছে। আমরা এখন নতুন সময় অতিক্রম করছি সবাই।
তথ্যসূত্র : ১। মীর মাসুদ (৬৭), পিতা- মীর কাসেম, মাতা- মেরেুন নেসা, ২। শামসুল আলম (৬১), পিতা- মৃত মসিরউদ্দিন, মাতা- সুন্নাতুন নেছা, ৩। আলহাজ¦ মো. ইয়াকুব আলী (৮৫), পিতা- শহিদ নহরউদ্দিন, মাতা- কবিরন নেছা, ৪। মো. শরীফ উদ্দিন (৬৯), পিতা- মৃত মো. ইউনুস আলী, মাতা- মৃত মো. ওলিমন নেছা, ৫। মো. সফিউদ্দিন (৯৭), পিতা- মৃত ডা. মফিজউদ্দিন, মাতা- আসমা খাতুন, ৬। মো. মখলেছুর রহমান, পিতা- মৃত নুরুল ইসলাম, মাতা- মেরীনা খাতুন, ৭। মীর মাহবুব (৬৩), পিতা- মীর কাসেম, মাতা- মেরেুন নেসা, ৭। মো. আজিজার রহমান চৌধুরী (৮৪), পিতা- মৃত মো. আব্দুল হাকিম, মাতা- কদম বানু, ৮। সাখাওয়াৎ হোসেন শওকত (৫৪), পিতা- আবুল হোসেন, সর্ব সাং-পাটুয়াপাড়া, জেলা- দিনাজপুর, ৯। গোলাম মজিদ বুলবুল (৭২), পিতা- মোবাশে^র হোসেন, মাতা- মাজেদা খাতুন, সাং- মুদিপাড়া, জেলা- দিনাজপুর।

  • আজহারুল আজাদ জুয়েল
    সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
    পাটুয়াপাড়া, সদর, দিনাজপুর

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।