আজহারুল আজাদ জুয়েল : দিনাজপুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নতুন একটি বইয়ের নাম। বইটিতে দিনাজপুর জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের নানান দিক ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। বইটি যখন হাতে এলো, এর বিশালত্ব দেখে অবাক না হয়েছি। ৬২৩ পৃষ্ঠার বিশাল আয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের জেলা ভিত্তিক ইতিহাস নিয়ে এত বড় বই হতে পারে, তা কল্পনার বাইরে ছিল।
প্রবাদ আছে আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারি। বইটি দর্শনধারী হয়েছে নি:সন্দেহে বলা যায়। যারা বইটির অবয়ব প্রথম দেখবেন, প্রথম দর্শনেই তাদেরকে ভাল লাগবে। কারণ এর চমৎকার প্রচ্ছদ, ঝকঝকা ছাপা আর বিশালত্ব। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের ছায়াচিত্র দিয়ে চমৎকার প্রচ্ছদ করার জন্য মোস্তাফিজ কারিগর অবশ্যই অভিনন্দন পাবার যোগ্য। ঝকঝকা ছাপার কারণে বইটি বার বার উল্টেপাল্টে দেখার ইচ্ছে তৈরী হয়। আর এর বিশালত্ব বিস্ময় সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের জেলা ভিত্তিক ইতিহাস নিয়ে এত বড় বই সাধারনত দেখা যায় না। সেদিক থেকে এর লেখক মোজাম্মেল বিশ^াস এই গ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন ডাইমেনশন এনেছেন তা নি:সন্দেহে বলা যায়।
মোজাম্মেল বিশ^াসকে বহু আগের থেকে একজন কবি হিসেবে জানতাম। দিনাজপুরের সরকারি সিটি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে গবেষক পরিচিতি লাভ করেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি আলাদা মাত্রায় উদ্ভাবিত হয়েছেন।
সম্ভবত লেখকের ১০ম গ্রন্থ ‘দিনাজপুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ’। ৬২৩ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের মাধ্যমে দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে তুলে ধরেছেন, কি গুণাবলী এতে আছে এখন সেটা দেখার বিষয়। দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এর আগে অনেকেই গবেষণা করেছেন, গ্রন্থ লিখেছেন এবং সেই গ্রন্থসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। মোজাম্মেল বিশ^াস যদি ঐসব গ্রন্থের বাইরে আরো কিছু তুলে আনতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে যে, গুণবিচারে তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। সূচি অনুযায়ী বইটিতে ১৫টি অধ্যায় অছে। শুরুতেই জেলা পরিচিতি। জেলা হিসেবে দিনাজপুর প্রতিষ্ঠার পটভূমি, দেশভাগ, বিবর্তন, মাইগ্রেশন, মোহাজেরদের আধিপত্য ও দৌরাত্ম, জেলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছেন পটভূমিতে। পটভূমির শেষাংশে দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ৮শত ৬৭টি গণহত্যার তথ্য দিয়েছেন। ঐ গণহত্যায় অর্ধলক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু নৃশংসতার শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে অর্ধশত বরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র, কবি ও বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, সে কথা উল্লেখ করেছেন।
পটভূমির পর পর্যায়ক্রমে লিখেছেন স্বাধিকার আদায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম, পাকিস্তান সরকার বিরোধী গণসংগ্রাম, অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র প্রতিরোধ, বিভিন্ন উপজেলায় হানাদার বিরোধী সংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ, স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি তৎপরতা, পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা, বিভিন্ন উপজেলায় বধ্যভূমি, চুড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ ও হানাদার মুক্ত বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, স্বাধীনতা উত্তর মুক্তিযুদ্ধ চর্চা, মুক্তিযুদ্ধোত্তর মূল্যায়ন, সারকথা। এই অধ্যায়গুলোর বাইরে গ্রন্থের শুরুতে ‘গ্রন্থ প্রসঙ্গ’ শিরোনামে ভূমিকা লিখেছেন লেখক নিজেই। আর শেষের দিকে আছে দিনাজপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিছু ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা।
গ্রন্থের ১৫টি অধ্যায়ের কোনটি গুরুত্বপুর্ণ, আর কোনটি গুরুত্বহীন তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা হতে পারে। তবে আমার মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এইসব অধ্যায়ের কোনটাকেই হালকা ভাবা যায় না। অর্থাৎ অধ্যায় সমূহের সবগুলোই গুরুত্ব বহন করে।‘স্বাধিকার আদায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম’ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়কালে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম বিশেষ করে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে নানামুখি তৎপরতায় যুক্ত সংগঠনসমূহের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। একটি বিষয় হলো যে, স্বাধীনতার ইতিহাস বলতে শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকেই বুঝায় না। বাঙালির ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান হতে শুরু করে পাকিস্তানি শোষণ, শাসন ও সামরিক জান্তা বিরোধী সকল আন্দোলন-সংগ্রামকেই স্বাধীনতার ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গন্য করা হয়। আর দিনাজপুরে সেইসব আন্দোলনের সবগুলোই সফলভাবে বাস্তবায়িত-সংগঠিত হয়েছে, যার সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে এই অধ্যায়ে।
‘পাকিস্তান সরকার বিরোধী গণসংগ্রাম’ অধ্যায়ের শুরুতেই আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরেছেন লেখক। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচন, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছাত্র সমাজের ১১ দফার আন্দোলন, ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচনসহ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বিভিন্ন সংগ্রামে দিনাজপুর বাসীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে।
অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিশেষ ও গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নিরংকুশ জয়লাভ করলেও তৎকালিন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ঐ আন্দোলনে দিনাজপুরবাসীর যে বিপ্লবী ভূমিকা ছিল তা পৃথকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র প্রতিরোধ অধ্যায়ে দিনাজপুরের মানুষ অসংগঠিত অবস্থায় যে সকল পদক্ষেপে হানাদার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিল এবং একটা পর্যায়ে সুসংগঠিত রুপ দিয়ে পরিকল্পিত লড়াইয়ে এই জেলাকে হানাদার মুক্ত করেছিল তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে হয়েছে, উপজেলার মানুষ কেমন করে প্রতিরোধ সংগ্রাম করেছেন এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন কেমন করে, কখন তাঁর একটা ধারণা দেয়া হয়েছে ‘বিভিন্ন উপজেলায় হানাদার বিরোধী সংগ্রাম’ অধ্যায়ে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে প্রতিরোধের মাধ্যমে, পরে গেরিলা আক্রমণে হানাদার বাহিনীকে পর্যদুস্ত করেছিল। এই লড়াইয়ের উপজেলা ভিত্তিক তথ্য দেয়া হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ’ অধ্যায়ে। দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ও তথাকথিত শান্তি কমিটির তৎপরতার মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতা করেছিল কিছু দালাল। সেই দালালদের তৎপরতার কিছু কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ‘স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি তৎপরতা’ অধ্যায়ে।
গণহত্যা হলো মুক্তিযুদ্ধের একটি ভয়াবহ দিক যা পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের দ্বারা নৃশংসতার সাথে সংঘটিত হয়েছিল। ‘পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা’ অধ্যায়ে তার কিছু কিছু কিছু তুলে ধরেছেন লেখক। এভাবে বিভিন্ন অধ্যায়ে দিনাজপুর জেলায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের পুর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন তিনি। মোজাম্মেল বিশ^াস যে সকল তথ্য-উপাত্ত তুলে এনেছেন এই গ্রন্থে তার সবগুলোতেই রেফারেন্স দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি রেফারেন্স হিসেবে অনেকের যেমন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তেমনি গবেষণা ভিত্তিক বিভিন্ন লেখকের বই, সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যকেও ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন লেখকের ৯৫টি গ্রন্থ, ৫২ জনের সাক্ষাৎকার ও ৭টি পত্রিকা-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধের সহায়তা নিয়েছেন লেখক। এর অর্থ হলো গ্রন্থটি প্রণয়নে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং সেই সব গ্রন্থ, পত্রিকা, ম্যাগাজিনের গুরুত্বপুর্ণ অংশ, যার মধ্যে দিনাজপুর রয়েছে, সেগুলোকে ব্যবহার করেছেন রেফারেন্স হিসেবে। যার ফলে ‘দিনাজপুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ’ একটি অমূল্য গবেষণা গ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক বধ্যভূমি রয়েছে এবং গণকবরের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। সেইসব গণকবর ও বধ্যভূমি নিয়ে সাংবাদিক ও গবেষকগণ প্রচুর লেখালেখি করেছেন। সেইসব লেখা হতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘বিভিন্ন উপজেলায় বধ্যভূমি’ অধ্যায়টি লেখা হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর জেলায় সংঘটিত যুদ্ধ, বিজয়গাঁথ্,া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ এবং স্বাধীনতা উত্তর মুক্তিযুদ্ধ চর্চা নিয়ে আলাদা আলাদা অধ্যায় লেখা হয়েছে গ্রন্থটিতে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, ‘দিনাজপুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি এই জেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি পরিপুর্ণ গ্রন্থ হয়েছে যেখানে লেখক এই জেলার মুক্তিযুদ্ধকালিন এবং এর আগের ও পরের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সামগ্রিক তথ্য তুলে ধরার চেস্টা করেছেন। পদে পদে রেফারেন্স ব্যবহারের কারণে এটি অমূল্য গ্রন্থ হয়ে উঠেছে যা ভবিষ্যতের গবেষকদের গবেষণায় অবদান রাখবে।
গ্রন্থটির পরিশিষ্ট অধ্যায়ে দিনাজপুর জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা দিয়ে তাঁদেরকে চিরস্মরণীয় করে রাখার প্রচেষ্টা নি:সেন্দেহে প্রশংসাপুর্ণ কাজ হয়েছে। সাদা কাগজে, ঝকঝকে ছাপায়, টাঙ্গন এর প্রকাশনায় একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ যুক্ত হলো তাতে সন্দেহ নাই। এটি দিনাজপুর জেলাসহ সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদেব্ধর ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। এরকম একটি উপহার দেয়ার জন্য লেখক, প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ৬২৩ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৪০০ টাকা। বর্তমানে ছাপা খাতে যে খরচ দাঁড়িয়েছে তাতে এত বড় একটি বইয়ের মূল্য খুব বেশি রাখা হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। এটি সকলের সংগ্রহে রাখার মত। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা জ্ঞাণের ভান্ডার বাড়াতে চান তাদের জন্য অপরিহার্য।
সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ।