ঢাকাসোমবার , ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০
  1. অন্যান্য
  2. অর্থ ও বাণিজ্য
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কাহারোল
  5. কুড়িগ্রাম
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খানসামা
  9. খেলা
  10. গাইবান্ধা
  11. ঘোড়াঘাট
  12. চাকরী বার্তা
  13. চিরিরবন্দর
  14. জাতীয়
  15. ঠাকুরগাঁও
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মুক্তিযুদ্ধকালিন পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর সচিব হুমায়ুন কবীর

মোফাচ্ছিলুল মাজেদ
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০ ৫:০৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আজহারুল আজাদ জুয়েল:- রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। মিছিল-মিটিংয়ে জড়িত থাকার কথাও শোনা যায় না। তবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগের থেকে দিনাজপুরের অন্যতম রাজনীতিবিদ মরহুম অ্যাডভোকেট এম আব্দুর রহিমের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। আলোচনা হতো দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর মনোভাবের পর্যালোচনা হতো। রাজনীতি বলতে ঐ পর্যন্তই। সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে এমন কথা কখনো তার ভাবনার মধ্যে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও দায়িত্ব গ্রহনের আগে পর্যন্ত এমনটা কখনো মনে আসে নাই। অথচ ঘটনা চক্রে মুক্তিযুদ্ধকালিন পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে!
তার নাম আলহাজ¦ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, পিতা- মরহুম মো. রফিউউদ্দিন আহমেদ, মাতা- মরহুমা তসলিমা খাতুন। বাড়ি দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি মহল্লায়। বাড়ির চেহারা তেমন আকর্ষনীয় না হলেও ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে গর্ব করার মত অনেক অর্জন আছে তার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর সচিবের দায়িত্ব পালনের কারনে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি তাকে ও তার পরিবারকে অনেক বেশি সম্মানিত করেছে বলে মনে করেন। ব্যক্তি জীবনে কিছুটা একরোখা, কিছুটা জেদী, কিছুটা নির্লিপ্ত তিনি। কিন্তু পরিচিতি আছে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে। দিনাজপুর শহরের কম-বেশি সবাই তাকে চেনেন। দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটে রেজিষ্ট্রার, দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সচিব ছিলেন তিনি।
খৃষ্টীয় ১৯৩৬ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালিন দিনাজপুরের কুসমন্ডি থানায় ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ মহিপাল গ্রামে সম্ভ্রান্ত ও বনেদী রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহন করেন হুমায়ুন কবীর। তার পিতা মহিপাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও ভূমি দাতা। তিনি পরবর্তীতে এই বিদ্যালয়কে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন।
হুমায়ুন কবীর পিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুুলে প্রাইমারি শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে ভর্তি হন বাংলাদেশের স্কুলে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পৃথক দুইটি রাষ্ট্রের (ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান) উৎপত্তি হলেও দুই দেশের নাগরিকদের যাতায়াতে তেমন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তখন মহিপালের সবচেয়ে কাছের স্কুল ছিল বর্তমান বাংলাদেশের (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) চেরাডাঙ্গি স্কুল, বাংলা স্কুল ও দিনাজপুর জিলা স্কুল। সীমান্তে বাধা না থাকায় হুমায়ুন কবীর ১৯৪৯ সালে জিলা স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন। কিছু অসুবিধার কারনে কিছুদিন পর জেলা স্কুল বাদ দিয়ে চেরাডাঙ্গি স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫৫ সালে ঐ স্কুল হতে মেট্রিক পাস করেন।
মেট্রিক পাসের পরেই তিনি মহিপালের নিকটবর্তী ভেলাকুড়ি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন এবং পশ্চিম দিনাজপুরের বংশীহারি থানার লালপুর গ্রাম নিবাসী মহিদুর রহমান চৌধুরীর কন্যা নুরবানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা লাভের স্বার্থে ১৯৬৪ সালে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা বাদ দিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৬৪ সালেই যোগ দেন দিনাজপুর হাই মাদ্রাসায় (বর্তমানে দিনাজপুর হাই স্কুল)।
১৯৬৫ সালে সেখান থেকেও বের হয়ে আসেন এবং দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বদলীজনিত কারনে ফেনী পলিটেকনিক, রাজশাহী পলিটেকনিক, বগুড়া পলিটেকনিক ও রংপুর পলিটেকনিকে চাকুরি করেন। ১৯৯৭ সালে দিনাজপুর পলিটেকনিক হতে রেজিস্ট্রার পদে অবসর লাভ করেন। ঐ বছরেই দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজে সচিব পদে যোগ দিয়ে ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দিনাজপুরের কয়েক লক্ষ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। হুমায়ুন কবীরও তার পরিবার-পরিজন সহকারে ভারতের মহিপালে তার পৈতৃক বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এম আব্দুর রহিমের যোগাযোগ থাকে। মহিপাল স্কুল সীমান্তের কাছে ছিল এবং সেখানে শরনার্থী ক্যাম্প করা হয়েছিল। সেই ক্যাম্প পরিদর্শন করতে এসেছিলেন দিনাজপুরের এমএনএ অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমপিএ অ্যাডভোকেট এম আব্দুর রহিম, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা কমরেড আব্দুস ছাত্তার, কসবার অ্যাডভোকেট সৈয়দ রিয়াজুল ইসলাম, ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার পরিবারের মঈনউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ভাষা সৈনিক ও ন্যাপ নেতা রফিক চৌধুরীসহ মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট দিনাজপুরের অনেক গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া দিনাজপুরের শিক্ষাবিদ মাহমুদ মোকাররম হোসেন, গাইবান্ধার অধ্যাপক আলিমসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি সেই সময় মহিপালে আসেন যাদের সাথে হুমায়ুন কবীরের দেখা ও কথা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মুজিবনগর সরকার বেসামরিক জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। গঙ্গারামপুরের একজন কমিউনিস্ট নেতা অহিন্দ্রনাথ সরকারের মালিকানাধীন বাড়িতে ১৯৭১ সালে ১৯ অক্টোবর গঠন করা হয়েছিল জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ওয়েস্ট জোন-১। দিনাজপুর ও রংপুরের বিশেষ অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই জোনের চেয়ারম্যান করা হয় দিনাজপুর সদর আসনের তৎকালিন এমপিএ এম আব্দুর রহিমকে। এর আগেই জোন গঠনের সভায় হুমায়ুন কবীরকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন এম আব্দুর রহিম। সৎ, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববান হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন কবীর সেই সভায় উপস্তিত হলে তাকেই মৌখিকভাবে জোনের সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। পরদিন লিখিতভাবে সচিব পদে নিয়োগ পত্র দেয়া হয়। পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন আবুল কাশেম (দিনাজপুরের এডিসি)। অফিসার ছিলেন আব্দুর রউফ (গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহি প্রকৌশলী) ও শরিফুল হক (তৎকালিন জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট)। জোনের হেড-এ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন অমর আলী। এছাড়া একজন হিসাব রক্ষক ও একজন পিয়ন ছিলেন যথাক্রমে আব্দুল গফুর ও মো. বশির।
অ্যাডমিনিেিস্ট্রটিভ জোনের কাজ ছিল শরনার্থিদের মনোবল চাঙ্গা রাখা, তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, আবাসনের সুবিধা নিশ্চিত করা, যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করা। এছাড়া বিভিন্ন রকমের বেসামরিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়া। জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ওয়েস্ট জোন-১ এর আওতায় ১১২টি রিলিফ ক্যাম্প, ১২টি ইয়োথ রিসিপশন ক্যাম্প, ৬টি ফ্রিডম ফাইটার ক্যাম্প, ১টি মুক্তিযোদ্ধা বাছাই ক্যাম্প ছিল। এম আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে হুমায়ুন কবীর ভারতের হিলি হতে রায়গঞ্জ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার এলাকায় শরনার্থী শিবির সমূহের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন রকমের বেসামরিক কার্যক্রম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পরিচালনার চেস্টা করেন। তিনি জানান যে, তিনি পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর গঙ্গারামপুরের কার্যালয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং বিভিন্ন ক্যাম্পের বিপরীতে বরাদ্ধ রিলিফ ও চিকিৎসা সামগ্রীসহ যাবতীয় মালামাল গ্রহন, সংরক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করতেন। সচিব হিসেবে তার বেতন ছিল ৪শ’ টাকা। এই জোনের অধীনেই ছিল সেক্টর-৭। সামরিক সেক্টর বিধায় পরিচালিত হতো আলাদাভাবে।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় সোসাইটি অব পার্লামেন্ট ওয়াচ নামের একটি সংগঠন ২০১৭ সালে হুমায়ুন কবীরকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননাপত্র ও ক্রেস্ট তুলে দেন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ।
হুমায়ুন কবীরের ১০ সন্তানের সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তার সন্তানদের মধ্য সুলতানা কবির হলেন একজন প্রকৌশলী ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত ইন্সট্রাক্টর (পাওয়ার), সুলতান আলী কবির হলেন নওগাঁ জেলার ক্রিড়া সংগঠক, সুফিয়া কবির বেবি হলেন বিরলের মুন্সিপাড়া আদর্শ কলেজের সহকারি অধ্যাপক, আবু সুিফয়ান কবির হলেন দৈনিক জনকন্ঠের এডিটোরিয়াল এসিস্ট্যান্ট, শাহন শাহ আজাদ কবির হলেন জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপ-সচিব, সাদিয়া সুলতানা হলেন দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (বাংলা), সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির স্টিভ হলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা ও নির্বাহি ম্যাজিষ্ট্রেট, সোহেলী আনার কবির মৌ হলন ঢাকার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। অন্য দুই সন্তান শাহিনা কবির রুপাা নওগাঁ ও শাহানা কবির গাজীপুরে থাকেন। তারা গৃহিনী। তবে শাহিনা কবির রুপা ১৯৯৪ সালে কোলকাতার দূরদর্শন আয়োজিত শ্রেষ্ঠ বিদেশী দর্শকের পুরস্কার লাভ করেন। তিনি নওগাঁ জেলার টিভি সেলিব্রেটি হিসেবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাফল্য প্রদর্শন করেন।
হুমায়ুন কবীর এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায় রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার গর্ব ও অহংকার আছে। তিনি মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো, তাহলে তার সন্তানদের আজ যে উচ্চাসন তৈরী হয়েছে সেই অর্জন আসত না। তাই একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব ও আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, দেশ তাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। আজহারুল আজাদ জুয়েল। সাংবাদিক, কলামিষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।