ঢাকাসোমবার , ৪ মে ২০২০
  1. অন্যান্য
  2. অর্থ ও বাণিজ্য
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কাহারোল
  5. কুড়িগ্রাম
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খানসামা
  9. খেলা
  10. গাইবান্ধা
  11. ঘোড়াঘাট
  12. চাকরী বার্তা
  13. চিরিরবন্দর
  14. জাতীয়
  15. ঠাকুরগাঁও
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ইন্ডিয়ায় প্রথম ভ্রমণ

মোফাচ্ছিলুল মাজেদ
মে ৪, ২০২০ ৫:৩২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আজহারুল আজাদ জুয়েল :-

ইন্ডিয়া সফরের প্রস্তুতি :
আমার নিজের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলা শহর আমার জন্মভূমি। এই জেলার পাটুয়াপাড়ায় ঠিক কবে আমার জন্ম হয়েছিল সঠিকভাবে জানা নেই আজও। মা লুৎফন নেছা বলতেন, পবিত্র রমজান মাসের বুধবার। কিন্তু সেই বুধবারের সালটা কত, তা জানাতে পারেননি কখনো।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে দিনাজপুর জেলা শহরের ঘাসিপাড়া প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম। মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে জান বাঁচাতে গ্রাম এলাকায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। বিরল উপজেলার ভবানীপুর, বিরল বাজার, নলদিঘি, বাজনাহার, মাটিয়ান, কাশিডাঙ্গা, কাহারোলের সাহাপাড়া পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম বাবা-মায়ের সাথে। যদিও এই পালিয়ে বেড়ানো ছিল জান বাঁচানোর জন্য কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা ছিল একেবারে অতি শিশুকালে আমার ভ্রমণ জীবনের সূচনা।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পরীক্ষা ছাড়াই ক্লাস ওয়ান হতে টু-এ উত্তীর্ণ হতে পরীক্ষা দিতে হয় নাই। অটো পাস করেছি। দিনাজপুর শহরের ঘাসিপাড়া প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। সেই স্কুল হতে ১৯৭৫ সালে ৫ম শ্রেণী পাস করলাম। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারী মাসে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার জন্য ৫ম শ্রেণী পাস করেছি মর্মে সনদপত্র অথবা প্রশংসাপত্র দরকার হলো। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে প্রশংসা পত্র চাইলে তিনি আমার জন্ম তারিখ আর সাল জানতে চাইলেন। আমি বলতে না পারায় মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ে পরদিন আবার স্কুলে যেতে বললেন প্রধান শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষকের কথা অনুযায়ী বাসায় এসে মাকে জিজ্ঞাসা করি, মা আমার জন্ম তারিখ কবে?
মা বললেন, রমজান মাস, বুধবার। হেড স্যারকে পরে সে কথা জানালে, তিনি লেখাপড়ার ৫ বছরের সাথে আরো ৬ বছর যুক্ত করে আমার জন্ম তারিখ নির্ধারণ করে দিলেন। তার দেয়া তারিখ অনুযায়ী আমার জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৯ নভেম্বর। সেই জন্ম তারিখ ও সাল অনুযায়ী আমার বর্তমান বয়স প্রায় ৫২। আমার সকল সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি কাগজপত্র তৈরী হয়েছে ঐ তারিখের ভিত্তিতে।
আমার ভ্রমণ জীবন শুরু হয়েছিল একেবারেই শিশু বয়সে মুক্তিযুদ্ধকালে পালাপালির মধ্য দিয়ে। এরপর বিরলে নানা-মামার (মরহুম বধু বিশ^াস নানা, তুফান মাষ্টার ও মন্টু মাষ্টার মামা) বাড়িতে যাতায়াতের মাধ্যমে। ১৯৭৩-৭৪ সালে আমার আপন বড় ভাই ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ (বাবলু) ভাই মারা গেলে বাড়িতে এক শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই সময় শোক লাঘব করার উদ্দেশে আমার খালু আজিজুর রহমান (তহশিলদার, বর্তমান নিবাস দিনাজপুর জেলা শহরের বালুয়াডাঙ্গায়) আমাকে ও আমার আরো দুই বোনকে (নূর ছিদ্দিকা রেহেনা ও লায়লা আজিজ রোজী) ফুলবাড়ি বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন তিনি সরকারি চাকুরী সূত্রে সেখানে বসবাস করতেন। সেখানে আমি এক সপ্তাহের মত ছিলাম। সেখানেই প্রথম একটি বেকারীতে আড্ডা মারার সময় হাফটোষ্ট তৈরী করার পদ্ধতি দেখেছিলাম। এর এক- দেড় বছরের মাথায় আমার বড় ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু হরিপুর উপজেলার কাঁঠালডাঙ্গি নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদ (সম্প্রতি মারা গেছেন। বর্তমানে তার বাড়ি রানীশংকৈলে) আমাকে তার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যান। সেখানে প্রায় এক সপ্তাহ ছিলাম। যখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র, সেই সময় কুড়িগ্রামের উলিপুর নিবাসী একজন সরকারি কর্মচারী শহিদুর রহমানের সাথে আমার পত্র মিতালী গড়ে উঠেছিল। পত্র মিতালীর সূত্র ধরে একদিন হঠাৎ করে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। বয়সে বড় ছিলেন বলে তাকে দেখে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি সাবলিল ভাবেই ‘মিতা’ বলে আমাকে সম্বোধান করছিলেন। তিনি আমাকে তার গ্রামের বাড়ি উলিপুর নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সময়। ট্রেনে করে গাইবান্ধা জেলা গিয়ে, সেখান থেকে হেঁটে তিস্তা নদী পেরিয়ে সেই সময় তার সাথে কুড়িগ্রামের উলিপুরে গিয়েছিলাম। সেবারেই প্রথম তিস্তা নদী দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে ছিলাম এক সপ্তাহের মত।
৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার যাতায়াত শুরু হয় কুষ্টিয়ার কেরু এ্যান্ড কোম্পানীতে। আমার বাবা ডাঃ আব্দুল আজিজ ছিলেন হোমিও চিকিৎসক ও ঔষধ ব্যবসায়ী। তার নামে রেক্টিফায়েড স্প্রিটের লাইসেন্স ছিল। স্প্রিট আনার জন্য কুষ্টিয়ার দর্শনায় গিয়েছি বহুবার। সেখান থেকে কখনো যশোহর, কখনো খুলনা-বাগেরহাট, কখনো রাজশাহী-চাঁপাইনবাগঞ্জ গিয়েছি। এভাবে একেবারে শিশুকাল থেকে আমার ভ্রমণ জীবন শুরু এবং এটা এখন এক ধরনের নেশা। আমার জীবনের অতি প্রিয় বিষয়। অর্থ সংকটে থাকি, সংসার চালাতে হিমসিম খাই তারপরেও নানান কৌশলে ভ্রমণের চেষ্টা করে থাকি।
নানান কাজের সূত্রে মানুষ রাজধানী ঢাকায় যায়। এটা হয়তো ভ্রমণের বিষয় নয়। কিন্তু কাজ না থাকা সত্বেও এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ৭ বার, খুলনায় ৭ বার, সিলেট-জাফলংয়ে ৩ বার, রাঙ্গমাটিতে দুইবার গিয়েছি। এছাড়া সেন্টমার্টিন, বরিশাল, বান্দরবান, ফেনী, নোয়াখালি, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, শায়েস্তাগঞ্জ, টাঙ্গাইল,ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ঝালকাঠি, কুমিল্লা, কুয়াকাটা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সুন্দরবন, ফরিদপুর, টুঙ্গিপাড়া সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এক থেকে একাধিকবার ভ্রমণ করেছি। বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া, বিরল, বুড়িমারী, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা, দর্শনা হল্ট, সোনামসজিদ, টেকনাফ, জাফলং সহ কয়েকটি জিরোপয়েন্টে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এভাবে দেশের নানান প্রান্তে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের প্রকৃতিকে জানার চেষ্টা করেছি। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সুন্দর, মনোরম দেশ বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ পরোপকারী, সংবেদনশীল এবং মহৎ গুণের অধিকারী এমন ধারণা আমার হয়েছে।
বাংলাদেশ ঘোরা হয়েছে ভালই। কিন্তু দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি কখনো। অথচ ভিন্ন দেশ না দেখলে নিজের দেশের প্রতি ভালবাসাটা এক তরফা হয়ে যায়। কারো সাথে তুলনা করার সুযোগ থাকে না। তাই দেশের বাইরে ঘোরার ইচ্ছে সব সময় আমাকে তাড়া করত।
আমার অর্থ সংকট আছে সেকথা বলেছি আগেই। তবুও বিদেশ দেখার ঝোঁকটা মন থেকে যেত না। আমার মনে হতো কোন একটা দেশে যদি যেতে পারতাম তাহলে জীবনের সার্থকতা কিছুটা বোধহয় আসত। সেক্ষেত্রে পাশের দেশ ইন্ডিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিতাম। এর কারণ এই যে, এটা সবচেয়ে কাছের। সেখানে যেতে খরচ কম। একদিন এই ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশ মিলে একই দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ইন্ডিয়ার বিশাল ভূখন্ডের ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রকৃতির অনেকটাই আমাদের মত, আমার বাংলাদেশের মত। দুই দেশের মননে, চেতনায়, আতিথিয়তায়, বন্ধুত্বে, ভালবাসায়, আত্মীয়তায় অনেক মিল আছে এমন কথা অনেক জনের কাছ থেকে শুনেছি। বই-পুস্তক পড়েও উপলব্ধি করেছি। তদুপরি আমি যে দিনাজপুরে বসবাস করি, সেই দিনাজপুর আর ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর মিলিয়ে বৃটিশ শাসনামলে একটাই দিনাজপুর ছিল। অথচ রাষ্ট্রিক ও ভৌগলিক বিভাজনে আজ আমরা আলাদা। তাই ভারতীয় অংশের দিনাজপুর দেখার ইচ্ছাও আমার মধ্যে কাজ করেছে দীর্ঘদিন। তাছাড়া খরচ কম-বেশি হওয়ার একটা বিষয় তো ছিলই। ভারত কাছের দেশ হওয়ায় অনেক কম খরচে, বিমান ছাড়া, ট্রেনে ও বাসে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু অন্য আর কোন দেশে এত কম খরচে যাওয়ার সুযোগ বোধহয় নেই। ফলে কম খরচে বিদেশ যাওয়ার টার্গেটে ইন্ডিয়া তথা ভারতকেই আমার কাছে সবচেয়ে ফেভারিট বলে মনে হয়েছে।
মূলত ভারত যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে দিনাজপুর পাসপোর্ট অফিসে আমার নামে পাসপোর্ট করতে দিয়েছিলাম। এ বিষয়ে সহযোগিতা করেছিলেন আমার বন্ধু বিএসএস এর দিনাজপুর প্রতিনিধি রোস্তম আলী মন্ডল। পাসপোর্ট এক মাসের মধ্যে আমার হাতে চলে এসেছিল। এতে খরচ হয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকার মত।
পাসপোর্ট হাতে এলেও সফরের জন্য প্রয়াজনীয় অর্থ সংস্থান হচ্ছিল না। ফলে ভিসা করতে করতে সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেল। পাসপোর্ট করার সাড়ে তিন বছর পর, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে দিনাজপুরের সাংবাদিক কামরুল হুদা হেলালকে ভিসা করতে দেই। এক মাসের মধ্যেই ভিসা হয়ে যায়। খরচ পড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এরপর ভ্রমণের সময় বের করা এবং টাকা যোগাড় করতে করতে আরো প্রায় ৩ মাস লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত জুন মাসে ইন্ডিয়া যাওয়া সম্ভব হয়। ২০১৫ সালের ৪ জুন তারিখে আমি বাংলাদেশ সরকারের ভ্রমণ ফি বাবত ৫শ’ টাকা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে জমা দেই। এর সপ্তাহ খানেক পর ১৩ জুন শনিবার দেড়শ ডলার ও নগদ ১০ হাজার টাকা নিয়ে ভারতের পথে রওনা দেই। ভারত সফরে পজেটিভ বিষয় যেমন পেয়েছি তেমনি নেগেটিভ বিষয়ও আছে। তবে সার্বিকভাবে এই সফর জীবনের দারুণ এক অভিজ্ঞতা।

আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে :
আজ অন্যরকম দিন আমার। আজ আমি এমন এক স্থানে এসেছি যেখানে আসতে অনেক ঝক্কি -ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অনেক আইনী প্রক্রিয়া মেইন টেইন করতে হয়েছে। নানান নিয়মের বেড়াজাল পেরোতে হয়েছে। অথচ কি আশ্চর্য যে, যদি আমি বৃটিশ আমলে জন্ম নিতাম তাহলে এত ঝক্কি-ঝামেলা পোড়াতে হতো না। যদি মুক্তিযুদ্ধের একাত্তরে আমার পরিবার সীমান্ত পার হওয়ার চিন্তা করত, তাহলেও ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই ইন্ডিয়ার ভেতরটা দেখে যেতে পারতাম। কি দূর্ভাগ্য যে, এখন সেই সুযোগটা নাই। নাই নির্বিঘেœ সীমান্ত পেরোনোর সুযোগ। এখন পাসপোর্ট, ভিসা নেয়ার পরেও কত রকমের ঝক্কি-ঝামেলা নিয়ে তবেই না দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ার ভিতরে ঢুকতে পারলাম।
আমি এখন ইন্ডিয়ার রায়গঞ্জে। এখানে একটি হোটেলে বসে লিখছি। আনন্দ হোটেল। এটা দোতলা, আবাসিক, বেশ পুরাতন। রায়গঞ্জ রেল ষ্টেশনের কাছেই। সন্ধ্যার দিকে এখানে এসে পৌঁচেছি। প্রথমবারের মত ইন্ডিয়ার ভেতরে আসা। মন বেশ ফুরফুরে। সেই গান, রবীন্দ্র সঙ্গীতের মত, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
নিজ দেশ বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার লালিত স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। সেই স্বপ্ন একবার কিছুটা মিটেছিল রবীন্দ্র সার্ধশত জন্ম বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে। বিশ^ কবির সার্ধশত জন্ম বার্ষিকীতে হিলির জিরো পয়েন্টে দুই বাংলার যৌথ সাংস্কৃতিক দলের আয়োজনে হয়েছিল নৃত্যানুষ্ঠান। সেটা দেখতে এসে ইন্ডিয়ান হিলি বাজারের পুরো অংশটা ঘুরে বেড়ানো হয়েছিল পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া! বিএসএফ সদস্যদের মৌখিক সম্মতি নিয়ে পুরো বাজার ঘুরেছিলাম তখন। তখুনি মনে হয়েছিল ইন্ডিয়ান হিলি এবং বাংলাদেশের হিলির মধ্যে কি পার্থক্য? তেমন কিছুই না। আমার কাছে দুই হিলিকে একই রকম মনে হয়েছিল। অথচ মাঝের জিরো পয়েন্ট, কিংবা নোম্যান্স ল্যান্ড, অথবা কাঁটাতার দুই হিলি, দুই বাংলার মানুষকে কিভাবে আলাদা করে রেখেছে!
ইন্ডিয়ার উদ্দেশে আজ সকাল ১০ টার দিকে বাংলাদেশের দিনাজপুর থেকে রওনা দিয়েছিলাম। পাটুয়াপাড়ার বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে একটি অটো গাড়ি যোগে জোড়া ব্রীজ। সেখান থেকে বাস যোগে সরাসরি বাংলা হিলি বা বাংলাদেশের হিলি। হিলির কাষ্টমসে এসে মোস্তফা নামের একজনকে খোঁজা।
মোস্তফার নাম বলে দিয়েছিলেন তপনদা (পরিমল চক্রবর্তী তপন, ডেমোনেষ্ট্রেটর, আদর্শ কলেজ-দিনাজপুর)। তিনি বলেছিলেন যে, সীমান্তের এপারে এবং ওপারে কাষ্টমস চেকপোষ্টের যে সকল প্রক্রিয়া আছে সেগুলো সম্পাদন করতে দু দিকেই কিছু লোক আছেন। সাধারণভাবে এরা দালাল হিসেবে চিহ্নিত। তবে তাদেরকে বিশ্বাস করা যায়। ওপারে ডলার বা টাকা ভাঙ্গাতে হবে। সেটাও দালালেরা করে দেয়। কাজটা দু নম্বরী হলেও লোক সলিড। দালালের হাতে টাকা দিয়ে বিশ্বাস করা যায় যে, এটা খোয়া যাবে না। কারন তাদের ব্যবসাই এটা।


তপনদা বাংলাদেশের কাষ্টমস সংক্রান্ত কাজ সম্পাদনের জন্য মোস্তফা এবং ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে তাপসের নাম বলেছিলেন। আমি যখন কাষ্টমসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন বেশ ক জন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেন, ইন্ডিয়া যাবেন না কি?
বললাম, ইন্ডিয়া যাব, তবে আমি মোস্তফাকে চাচ্ছি।
একজন দেখিয়ে দিলেন ঐ যে মোস্তফা। দেখলাম, লোকটার বয়স চল্লিশের উপরে। দাড়ি রেখেছেন। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন কাষ্টমস কর্মকর্তাদের কাছে। প্রয়োজনীয় সব কাজ তিনিই করলেন, আমার ছবি নেয়া হলো সেখানে। প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল সব কিছু করতে, এরপর তিনি ফি নিলেন ১২০ টাকা। বললেন, ঐ পারে গিয়ে ওদের কাছ থেকে কাগজ-পত্র ওকে করে নিয়েন।
হিলি রেললাইন চলে গেছে বাংলাদেশের ভূমির উপর দিয়ে। কিন্তু রেল লাইন ক্রস করলেই ইন্ডিয়া। সম্ভবত বাংলাদেশের মধ্যে হিলিই একমাত্র রেল স্টেশন যেটা ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা। রেল লাইন পেরিয়ে ইন্ডিয়ার ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে সেখানেও বেশ ক’জন আমাকে ঘিরে ধরেন। ‘দাদা, কাষ্টমসের কাজ করবেন না?’ জিজ্ঞাসা করেন তারা।
আমি বলি, কাজ করব, তবে তাপসকে খুঁজছি। একজন অল্প বয়সী যুবক, তার নাম বম। কাছে এসে বললেন, আমি তাপসের ভাতিজা।

২৭-২৮ বছর বয়সী এই যুবক আমার পাসপোর্ট নিলেন। কাষ্টমস এর যাবতীয় কাজ করে দিলেন। তারপর বললেন, টাকা ভাঙ্গাবা? দাও কত টাকা ভাঙ্গাবা? তার হাতে ১০ হাজার বাংলাদেশী টাকা দিলাম। তিনি কিছুক্ষন পর ৮ হাজার ইন্ডিয়ান টাকা আমার হাতে এনে দিলেন। এর মধ্যে ১শ টাকা নিয়ে বললেন, এটা আমার মজুরী। এ ভাবে কাজ সেরে হিলি চেকপোষ্ট থেকে হেঁটে হেঁটে বাজারের ভিতর দিয়ে বাসষ্ট্যান্ডে আসি। সেখানে বালুরঘাটের বাসে উঠি ২০ টাকা ভাড়ায় ।
শুনেছি ভারতের মেয়েরা বেশ ফ্রি। তারা ট্রেন-বাসে ইজিলি ছেলেদের পাশে বসে। এই শোনা কথার বাস্তব রুপায়ন যেন হিলি থেকেই দেখলাম । আমি বাসে উঠে যে সিটে বসে ছিলাম, সেটা ফাঁকা ছিল। সেখানে এক দেড় মিনিটের মধ্যে ১ জন কলেজ ছাত্রী এসে আমার পাশে বসে পড়লেন। পাশে আরো সিট ফাঁকা ছিল, সেখানেও বসতে পারতেন তিনি। কিন্তু তা না করে আমার পাশেই! গাড়ীতে চলতে চলতে মেয়েটির সাথে গল্প জমালাম। জানলাম যে তার নাম ববিতা খাতুন। বালুরঘাটের দিওর উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার সাথে সময়টা গল্প করে ভালই কাটল গাড়িতে।
বালুরঘাট পর্যন্ত বাস চলতে চলতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। যখন সেখানে নামলাম, রাস্তাঘাট ভেজা ভেজা, আকাশ ঘোরতর মেঘলা এবং তখনো ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মাঝেই গোটা কয়েক ছবি তুললাম। কিছু সেলফি। কিছু ছবি তুলে দিলেন সুদীপ্ত নামের একজন রিকসা চালক। সুমন নামের এক যুবকের সাথে পরিচয় হয়েছিল গাড়িতে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার হোটেল দেখতে পাচ্ছিনা। এখানে হোটেল নাই না কি? যুবক জানালেন, রাস্তার ঐ পাড়ে আছে। তারপর বললেন, আমিও খাওয়া করব, চলেন যাই।
গেলাম হোটেলটাতে। হোটেল পান্থনিবাস। নিরামিষ হোটেল। ভাল লাগল, কারণ আমি নিরামিষ চাই। খরচ কম, আবার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ডাল সহ চার পদের নিরামিষ তরকারি দিয়ে ভাত খেলাম ৪০ টাকায়। হোটেলটিতে টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল, সেটা সারলাম বিনা খরচে। বেশ আরাম পেলাম।
খাওয়া শেষে সুমন কালিয়াগঞ্জের উদ্দেশে বাস ধরল। আমি কিছুক্ষণ বালুরঘাটেই ঘুরপাক করলাম। বালুরঘাটে প্রথম আসা। তাই একটু দেখে নেওয়া। ঘুরতে ঘুরতে আনন্দময়ী ষ্টোর্স নামের একটি দোকান থেকে রেজার, সাবান, পেষ্ট, টুথ ব্রাশ, ফেয়ার এন্ড লাভলী কিনলাম। তার পাশের দোকান থেকে একটি টুপি (হ্যাট) নিলাম রোদ থেকে মুখ রক্ষার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে বালুরঘাট বাস ষ্ট্যান্ডে এসে ভাবলাম, কোথায় যাব? লোককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে, বালুরঘাটের পর আছে গঙ্গারামপুর, তারপর বুনিয়াদপুর তারপর রায়গঞ্জ।
দিনাজপুররের কবি চঞ্চল গুপ্ত তার কয়েকজন নিকট আতœীয়ের ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, আমি যেন তাদের সাথে দেখা করি। তাদের কারো বাড়ি কালিয়াগঞ্জ, কারো বাড়ি গঙ্গারামপুর, কারো বাড়ি কলকাতা। গঙ্গারামপুর দিনাজপুরের কাছের এলাকা। একাত্তরে এই থানার নাম শুনেছি বহুবার। তাই ভাবলাম, আগে সেখানে যাই, তারপর ভাবা যাবে কি করা যাবে। উঠলাম গঙ্গারামপুরের উদ্দেশে। ভাড়া ৩০ টাকা।
এক ঘন্টারও বেশি সময় পর টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বাস গংগারামপুরের যেখানে থামল সেটা একটা বড় ধরনের মোড়। বিশাল এক মার্কেট ভবনের সামনে এসে থামল বাসটি। আমি নামলাম সেখানে। নামার সাথে সাথেই এমন তুমুল বর্ষন শুরু হলো যে, আমার মধ্যে বিরক্তি এসে গেল। এই বৃষ্টিতে কোথায় যাব? ভেবে কোন কূল কিনারা করে উঠতে পারলাম না। হাতে ব্যাগ ব্যাগেজ না থাকলে হয়তো খারাপ লাগতনা। কিন্তু এগুলো নিয়ে কোথাও মুভ করতে পারলাম না। বৃষ্টি মূষলধারে চলতেই থাকল।
গংগারামপুর বাস ষ্ট্যান্ডের সাথে বিশাল এক সুপার মার্কেট। মার্কেটের মূল ভবনের ছাদ রাস্তার দিকে অনেকটাই বাড়ানো। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হলো না। সেখানে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিলাম, দুধ চা। সাধারনত লাল চা খেয়ে থাকি। কিন্তু সেটা হলো না। এখানে লাল চা নাই। অথচ অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্বস্তি এসে গিয়েছিল। অস্বস্তি দূর করতে মনে হলো, এক কাপ চা অবশ্যই দরকার। লাল নেই, তাই দুধ চা নিলাম। কিন্তু মুখে দিয়ে শেষ করতে হলো খুব কষ্টে। চা যেমন তেতো, তেমনি বিস্বাদ।

রায়গঞ্জ রেল ষ্টেশনে

বৃষ্টি এক সময় কমে এলো। কমল, কিন্তু ছাড়ল না। ঝির ঝির করে হতেই থাকল। এমন অবস্থায় মনে হলো, দরকার নেই গঙ্গারামপুরে থাকার, বরং রায়গঞ্জে চলে যাই। থাকতে হলে সেখানেই থাকি। যেমন ভাবা। বিকাল চারটার দিকে রায়গঞ্জগামী একটি বাসে উঠে পড়লাম। বাস কন্ডাক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাবেন? কোন রকম জড়তা এলো না ‘রায়গঞ্জ’ কথাটা বলতে। রাত প্রায় ৯টার দিকে বাস এসে দাঁড়াল রেল ষ্টেশনের পাশে, বাস টার্মিনালে।
এখান থেকে কোথায় যাব, কোথায় উঠব তা নিয়ে ভাবনা শুরু হলো আমার। এত রাতে অজানা, অচেনা জায়গায় বেশি ঘোরাফেরা নিরাপদ নয়। একটা আবাসিক হোটেলে উঠে পড়তে পারলেই রক্ষা। টার্মিনাল থেকে কয়েক কদম হেঁটে রাস্তার উপরে এসে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি, আবাসিক হোটেল এখানে কোথায়?
একজন বললেন, ঐযে ঐটা।
বহুতল ভবনের সেই হোটেলটিতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, সিংগেল রুমের ভাড়া কত? হোটেলের একজন জানালেন, সিংগেল নাই, ডাবল আছে। ভাড়া ১১শ’ টাকা।
আর কোথায় হোটেল আছে? প্রশ্ন আমার।
টেম্পোয় উঠে আনন্দ হোটেলে চলে যান। এখান থেকে কাছেই। ৫ টাকা ভাড়া লাগবে। বেশ আন্তরিকতার সাথে জানালেন লোকটি।
৫-৬ মিনিটের মধ্যেই আমাকে আনন্দ হোটেল এর সামনে নামিয়ে দেয় একটি টেম্পো। হোটেল কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নেই। সিংগেল রুম আছে কি না? কাউন্টারে একজন বয়স্ক লোক ছিলেন। বললেন, আছে। ভাড়া ২০০ টাকা। আমি রুম নিলাম। খাতায় নাম ধাম লেখা হলো। কাউন্টারের লোক জাতীয় পরিচয় পত্র চাইলেন। বললাম, আমি তো বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
লোকটি বললেন, পাসপোর্ট দেন।
দিলাম। কোন ঝামেলা হলো না রুম পেতে।
ভবনটি বেশ পুরনো। যে রুমটিতে উঠলাম, সেটি দোতলার ঠিক মাঝামাঝি অবস্থান। একটু স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। তবু সেখানেই উঠলাম। যে বয় রুম খুলে দিয়ে গেল, সে জানতে চাইল, আমি মদ-বিয়ার খাব কি না। যদি খাই, তাকে যেন বলি।
আচ্ছা, বলব, বলে তাকে বিদায় দিলাম। এরপর টয়লেট সেরে, হাত মুখ ধুয়ে, দশ মিনিট রেষ্ট নিয়ে মনে হলো, খাওয়া সেরে আসি। সেই সাথে ইন্ডিয়ান সীম পেলে নিয়ে নেই। রাত প্রায় দশটার দিকে হোটেল থেকে বের হয়ে এলাম। তার আগে হোটেল কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করে নিলাম, ইন্ডিয়ান সীম কোথায় পাব? কাউন্টারের লোক জানালেন, রাস্তার বাম দিক দিয়ে গেলেই সীম-মোবাইলের দোকান পাওয়া যাবে।
আমি রাস্তার বাম দিক ধরে কয়েক মিনিট হেঁটে যেতে সেই দোকান পেলাম। ১০০ টাকায় একটি সীম নিলাম। এরপর একটি হোটেলে পুরি, ভাজি খেয়ে আবার আবাসিক আনন্দে ফিরে এলাম। নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে ফোন দিলাম আশিষ কুমার ঘোষকে। তার বাড়ি এই রায়গঞ্জে। দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি চিত্ত ঘোষের আপন বোনের ছেলে। রিং দিলাম। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে রিসিভ হওয়ার আওয়াজ পেলাম, হ্যালো?
: আপনি আশিষ কুমার ঘোষ বলছেন?
: জি বলছি?
: আমার নাম আজহারুল আজাদ জুয়েল। বাংলাদেশের দিনাজপুর থেকে এসেছি। আপনার মামা চিত্ত ঘোষ আপনার কথা বলেছেন।
: জি জি, চিত্ত মামা আপনার কথা আমাকে বলেছে। আপনি এখন কোথায় আছেন?
: আমি হোটেল আনন্দে উঠেছি।
: ও আচ্ছা, খুব ভাল করেছেন। আপনি থাকেন সেখানে, কাল সকালে আপনার সাথে দেখা করব।
: আচ্ছা, তাহলে কাল সকালে।
এভাবেই আমাদের কথা হলো অনেকক্ষন। এরপর কিছুক্ষন টিভি দেখলাম। টিভিতে ইন্ডিয়ান বাংলা চ্যানেল ছাড়া কিছু পেলাম না। ভাল অনুষ্ঠান একটা চ্যানেলেও নাই। তবুও কিছুক্ষন টিভি দেখলাম, দেখেতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম।-(উপরের অংশটি লেখার তারিখ ১৩ জানুয়ারী ২০১৫ শনিবার রাত ১২ টা, হোটেল আনন্দ, রায়গঞ্জ, ইন্ডিয়া)

চিত্তদার বোনের বাসায় :
দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি চিত্ত ঘোষের আপন বোনের বাড়ি রায়গঞ্জে আছে, এটা জেনেছি ইন্ডিয়ায় আসার ২-৩দিন আগে। চিত্তদা জানিয়েছিলেন, তার এই বোন ও ভগ্নীপতি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে এসে আর বাংলাদেশে ফিরে যায়নি। সেই বোন-ভগ্নীপতি এখন বেঁচে নেই, রয়েছে তাদের সন্তানরা।
আশিষ কুমার ঘোষ (৫৩) হলেন ঐ বোনের ছেলে। চিত্তদা তাকে বাংলাদেশ থেকে ফোনে আমার কথা জানিয়ে বলেছিলেন যে, আমি ভারতে প্রথম যাচ্ছি, যে কোন প্রয়োজনে সে যেন আমাকে সহযোগিতা করে। আশিষ বলেছিলেন, কোন অসুবিধা হবে না মামা, তুমি পাঠিয়ে দাও।

ভারতে সবখানেই মনীষীদের এইরকম ভাস্কর্য দেখা যায়

সেই আশিষকে ইন্ডিয়া আসার পরদিন দেখলাম। তিনি পরদিন সকালেই হোটেল আনন্দে এসে আমাকে দেখা দিলেন। হাসি-খুশি, চটপটে, কথাবার্তায় আন্তরিকতাপুর্ণ, তবে একটু বাউন্ডেলে ভাব।
চিত্ত ঘোষের ভগ্নীপতির বাড়ি, যা এখন তার ছেলে আশিষ-অশোকের বাড়ি, এখানে এসেছি গতকাল সকালে। হোটেল আনন্দ থেকে আশিষ নিয়ে এসেছেন। বাড়িটি রায়গঞ্জের দক্ষিণ বিননগর গ্রামে। রায়গঞ্জ রেল স্টেশন হতে এর দূরত্ব হতে পারে এক- দেড় কিলোমিটার। বাড়ির বাইরের গেটটি দর্শনীয়। তাতে বুনিয়াদি ভাব আছে। তবে পরে বুঝেছি যে, চিত্তদার বোনের এই ছেলেরা বিত্তের দিক থেকে যথেষ্ট কষ্টে আছেন। আশিষ তেমন কিছু করে না। অনেকটা ভবঘুরে টাইপের। বিয়ে করেনি। বাংলাদেশ থেকে লোকজন এলে তাদেরকে সেবা দেয়ার বিনিময়ে কিছু হলে হলো, নইলে দুঃখ। অশোক জেলখানায় খাদ্য সরবরাহ করেন। ঠিকাদার। কিন্তু বাংলাদেশের ঠিকাদারদের যে চকচকে চেহারা দেখা যায়, অশোকের চেহারায় সেই চকচকি নাই। তবে তাদের মন বড় সেটা বুঝেছি ঐ বাড়িতে দেড়দিন থেকে।
বাইরের গেট দিয়ে ঢোকার পর বেশ বড় পরিসরের একটি ফাঁকা জায়গা দেখা যায়। এর ডানে আছে ৩টি টিনের ঘর। সেখানে বাইরের লোকেরা ভাড়ার বিনিময়ে গাড়ি রাখেন। ভাড়া প্রতিটি ঘরের জন্য মাসে ৫০০ টাকা। ফাঁকা পরিসরের জায়গা পেরিয়ে কিছুটা গেলে পাওয়া যাবে একটি কালি মন্দির। মন্দিরে মাঝারি সাইজের কালি প্রতিমা। তাতে পুজো করেন এই বাড়ির লোকেরা। কালি মন্দিরের সামনে বাম পাশ দিয়ে আরেকটি গেট। সেটা দিয়ে ঢুকলে অশোকদের মূল বাড়ি। মন্দিরের পেছনে রয়েছে টিনের আরেকটি বড় ঘর । সেখানে থাকেন অবিবাহিত আশিষ। তার ছোট ভাই বিবাহিত অশোক বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকেন বাড়ির মূল অংশের ভেতরে।
এটা ভাল লাগার মত একটি পরিচ্ছন্ন বাড়ি। অশোকের স্ত্রী পিংকি সকাল থেকেই নানান ব্যস্তটায় যে কাজগুলো করেন, তার প্রধানতম হলো ঘর ঝাড় দেয়া, আঙ্গিনা ঝাড় দেয়া, পুজো দেয়া, পানি ছিটানো। এগুলো সারাদিনে একবার, দু’বার নয় বহুবার করেন তিনি। ঘর, বারান্দা, আঙ্গিনা এমন কি বাইরের প্রাচীর বেষ্টিত যে খোলা জায়গা সেটাও ঝকঝকে, পরিস্কার থাকে সারাদিন।
বাড়ির আঙ্গিনার মাঝখানে পাকা বেদীতে তুলসী গাছ লাগানো। তার পাশে দোলপুজার বেদী। পাশে লাল চন্দন গাছ। ডালিম, পেয়ারা সহ কয়েক ধরনের ফলগাছও। বাড়ির এক পাশে ছোট একটা পুজোঘরের মত। সেখানে প্রতিদিন ফুল ও ধুপ দেন অশোক ও পিংকি। কিন্তু আশিষকে পুজা-পার্বনের মধ্যে কখনো দেখিনি।
অশোকের সাথে গল্প হচ্ছিল এইসব নিয়ে। খুবই ধর্মানুরাগী। কালি প্রতিমার সামনে গেলেই দু হাত তুলে ভক্তি জানান। তুলসী গাছে পুজো দেন। আঙ্গিনায় সারাদিনে কয়েক দফা পানি ছিটিয়ে পবিত্রতা আনেন। অশোকের পিসিমা মনজু ঘোষ জানালেন, এই বাড়িতে আগের থেকেই কালি থাকতেন। যখন বাড়ির ভিতরে একটি পাকা ঘর করা হচ্ছিল, সেই সময় কালিমাতা স্বপ্নে তার জন্য একটি ঘর বানিয়ে দিতে বলেছিলেন। তার সূত্রে এখানে ছোট ঘরটি করা হয়েছিল। কিন্তু এর কয়েক বছর পর কালি মাতা স্বপ্ন দেখিয়ে আবার বলেন যে, এত ছোট্ট ঘরে তিনি থাকতে পারছেন না। এরপর ছোট ঘরের পাশে একটি বড় ঘর দিয়ে বড় আকারের কালি প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
মুসলিম ধর্মের লোক হিসেবে সুফি-সাধক কিংবা আলেম-ওলামাদেরকে স্বপ্ন দর্শানোর কথা শুনতাম। এবার সনাতন ধর্মের এক বাড়িতে এসে স্বপ্নে কালি দর্শনের কথা জানলাম। মুসলিম হিসেবে এই স্বপ্নের কথা হয়তো আমার বিশ^াস করা ঠিক না। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা বিশ^াস করছি। এ কথা সত্য যে মানুষ স্বপ্ন দর্শণ করে। স্বপ্নে অনেক কিছু দেখতে পায়। একজন মানুষ যে বিষয় নিয়ে বেশি ভাবেন, বেশি চিন্তা করেন, বেশি বেশি কল্পনা করেন সেটা অনেক সময় তিনি স্বপ্নেও দেখতে পান। কাজেই কালি দর্শনের যে গল্প শুনলাম, তা সত্য বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হলো এবং াামি সেটা বিশ^াসও করলাম।
আগেই বলেছি, এই বাড়িটি চিত্তদার সবচেয়ে বড় বোন জ্যোস্না ঘোষের। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা সেতাবগঞ্জ থেকে এখানে এসেছেন। ভারতে আসার পর আর বাংলাদেশে ফিরে যান নি। এই জায়গা কিনে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। চিত্তদার ভগ্নীপতি গোপাল ঘোষ এখানে বাড়ি করলেও বাংলাদেশে তিনি চিটাগুড় সরবরাহের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। সেতাবগঞ্জ সহ বাংলাদেশের ১৮-২০টি চিনিকলে চিটাগুড় দিতেন। তিনি বাংলাদেশের ঢাকায় হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছেন এবং সেখানেই তার দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে এই বাড়িতে থাকেন চিত্তদার বোনের ছেলে আশিষ ও অশোক, অশোকের স্ত্রী পিংকি ঘোষ, একমাত্র শিশুপুত্র অর্পন ঘোষ ও পিসি মনজু ঘোষ (৬১)।
দিলীপ ঘোষ ও তার বোন ঝর্না ঘোষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আশিষদের বিননগরের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বেজে গিয়েছিল গতকাল। রাতে আমাকে ভাত খেতে দিলেন অশোকের স্ত্রী পিংকি। সেই সময় অশোকও আমার সাথে বেশ গল্প জুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সংসারের সুখ-দুঃখের গল্প। তিনি জেলখানায় খাবার সরবরাহের ঠিকাদারী করেন। তার বড় ভাই কিছুই করে না, শুধু শুধু ঘুরে বেড়ায় এইসব গল্প। অশোক আমাকেও বিভিন্ন প্রশ্ন করে আমার সম্পর্কে, আমার পরিবার সম্পর্কে জেনে নিলেন। পিংকি বার বার বললেন, মামা, আমরা গরীব মানুষ বলে কম খাবেন না কিন্তু। এভাবে নানান কথা, নানান গল্প শেষে রাত প্রায় ১১টার দিকে শুয়ে পড়ি।

একজন ঝর্না ঘোষ :
আশিষ একটু উ™£ান্ত টাইপের। তার কোন কাজ নাই ঘুরে বেড়ানো ছাড়া। সে কমিউনিষ্ট সমর্থক। বামপন্থী কর্মীদের সাথে ভাল যোগাযোগ আছে এটা বোঝা গেল বন্দর বাজার গিয়ে। সে আমাকে রাসবিহারী বাজার ও বন্দর বাজার দেখাল। কুলিক নদী দেখাতে নিয়ে গিয়ে দেশবন্ধু পাড়ায় তার এক পিসি ঝর্না ঘোষের বাড়ি নিয়ে গেল, যিনি কমিউনিষ্ট আন্দোলনের ভাল একজন কর্মী ছিলেন।
ঝর্না ঘোষকে দেখে আমি ভিষণ মুগ্ধ হলাম তার অনিন্দ্য সুন্দর, সৌম্য পবিত্র চেহারা দর্শনে। বয়স হয়েছে, চুল পেকে গিয়ে সাদা হয়েছে, কিন্তু তার চেহারাটা এমন যে, তাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
ঝর্না ঘোষের বাড়িতে প্রায় দেড় ঘন্টা ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে খুশি হলেন। চা, বিস্কিট, ফুচকা খাইয়ে আপ্যায়ন করলেন। দেড় ঘন্টা সময়ের মধ্যে তার কাছ থেকে জানলাম যে, তিনিও বাংলাদেশে ছিলেন। ঠাকুরগাঁও জেলায় তার বাড়ি ছিল। তেভাগা আন্দোলনের অনেক কিছু দেখেছেন।

রায়গঞ্জে ঝর্ণা ঘোষ ও আশিষ কুমার ঘোষের (মাঝে) সাথে আমি

ঝর্না ঘোষের পিতা মৃত নর নারায়ন ঘোষ ছিলেন বীরভূমের মানুষ। বৃটিশ শাসনামলে চাকুরী সূত্রে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ে গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন। ঠাকুরগাঁওয়ের কালিবাড়ি এলাকায় তাদের ২০ বিঘা জমির উপর বাসস্থান ছিল। সেখানে সরকার পাড়ায় ১২ বিঘা জমিতে ছিল আম বাগান। সেই আমবাগানে এখন ফায়ার ব্রিগেড হয়েছে। ১৯৪৭ সালে যখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছিলেন সেই সময় তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের সময় তিনি ছোট ছিলেন। ঠাকুরগাঁওয়ের যেখানে তাদের বাড়ি ছিল সেই বাড়ির সংলগ্ন মাঠে তেভাগা আন্দোলনের কর্মীদের সংগঠিত হতে এবং অনেক লাঠি জমা করতে তিনি নিজে দেখেছেন বলে জানালেন।
আন্দোলনের নেতা হাজী দানেশ, কম্পরাম সিং, সুনীল সেন সহ অনেক নেতাকে দেখেছেন বাড়ির পাশের এই মাঠে। সেই মাঠে তিনি তার নিজ মাতা সুরত মোহিনী ঘোষসহ অনেককে তেভাগা আন্দোলনের খরচ যোগানোর জন্য গয়না দিতে দেখেছেন। তিনি হাজী দানেশের মেয়ে মিনাদিকেও দেখেছেন। মিনা এবং ঠাকুরগাঁওয়ের আশু ভাদুড়ির ৭ মেয়ে যথাক্রমে মন্টু ভাদুড়ি, গীতা ভাদুড়ি, বোচা ভাদুড়ি, ইতু ভাদুড়ি, সিতু ভাদুড়ি ও মনি ভাদুড়ি সহ আরো অনেক মেয়েকে মাঠে জড়ো হয়ে সমবেত কন্ঠে তেভাগার পক্ষে গান গাইতে দেখেছেন এবং নিজেও সেই গান শুনেছেন। ভারত বিভক্তির পর ১৯৫২ সালে যখন পাসপোর্ট প্রথা চালু হয় তার দুইদিন আগে পিতা নর নারায়ন ঘোষ পরিবার পরিজন নিয়ে চলে আসেন এখানে, এই রায়গঞ্জে। সেই থেকে তিনি ভারতেই আছেন। মাঝে দু-একবার ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
তেভাগা আন্দোলন দেখে কমিউনিজম ভাবধারায় আসক্ত ছিলেন ঝর্না ঘোষ। ভারতে এসে যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিষ্ট রাজনীতির সাথে। মার্কসবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি’র অবিভক্ত দিনাজপুর (উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর) জেলা কমিটি’র সভাপতি ছিলেন এক নাগাড়ে ২০ বছর। তার ৪ ছেলে ১ মেয়ে। সেজো ছেলে অরুপ ঘোষ রায়গঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন কয়েক বছর আগে।
দেশবন্ধু পাড়া জায়গাটির নাম আগে ঠনঠনিয়া পাড়া ছিল। কিন্তু এলাকার অধিকংশ মানুষ ছিলেন কমিউনিষ্ট আদর্শের। তারা যুক্ত হয়ে এর নাম দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নামে রাখেন দেশবন্ধু পাড়া। এই পাড়ার অধিবাসী হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করেন ঝর্না ঘোষ। তিনি জানান, ছোট থাকায় তিনি তেভাগা আন্দোলনে যুক্ত থাকতে পারেননি। কিন্তু সেজো ভাই সত্য নারায়ন ঘোষ (বর্তমানে মালদায় থাকেন) তেভাগা আন্দোলনে গোপনে যুক্ত থাকতেন। গোপনে থাকতেন কারন তিনি সরকারী চাকুরী করতেন।

একজন দিলীপ ঘোষ :
ঝর্না ঘোষ তেভাগা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বার বার বলছিলেন যে, তার বড় ভাই দিলীপ নারায়ন ঘোষ ভাল জানেন। তিনি আরো ভাল বলতে পারবেন।
: কোথায় থাকেন দিলীপ ঘোষ?
: তিনি এ পাড়াতেই থাকেন। রাস্তার ঐপাড়ে ৩-৪ বাড়ি পরেই দাদার বাড়ি।- জানান ঝর্না ঘোষ।
তখন মনে হলো, যাই তার কাছে। ঠাকুরগাঁওয়ে ছিলেন তিনি। হয়তো অনেক কিছু জানা যাবে ঠাকুরগাঁও সম্পর্কে। অতঃপর ঝর্না ঘোষ বিকাল বেলা নিয়ে গিয়েছিলেন তার বড় দাদার বাড়িতে।
৭৫ বছর বয়সী দিলীপ ঘোষ আমার পরিচয় পেয়ে খুব ভাল ভাবে আম, মিষ্টি সহ ৬-৭ রকমের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। এরপর নানান আলাপ। আলাপ থেকে যে তথ্য পেলাম তা হলো এ রকম;
ঠাকুরগাঁওয়ের পুর্ব নাম ছিল নিশ্চিন্তপুর। বৃটিশ আমলে ঐ নাম বদলে দিয়ে ঠাকুরগাঁও রাখা হয়। সেখানে যে তেভাগা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন হাজী দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বুজঙ্গ ভূষন পালিত, কম্পরাম সিং প্রমুখ। আন্দোলনে নারী, পুরুষ সবাই অংশ নিত। রাজবংশী মেয়েদের অংশ গ্রহণ বেশি ছিল। ফুলবাড়ীর তেভাগা আন্দোলনের নেতা জ্যোতির্ময় দাসের গোপন নাম ছিল শান্তি দাস। দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি নিবাসী দু’ভাই শংকর রায় ও ভগতোষ রায়, কালিতলা নিবাসী সুশীল সেন যুক্ত ছিলেন তেভাগা আন্দোলনে। সুশীল সেন কমিউনিষ্ট পার্টি, দিনাজপুর জেলা শাখার প্রথম সেক্রেটারী ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আমলে দিনাজপুরের কালিতলা নিবাসী এবং বর্তমান কলকাতা নিবাসী শ্যামল সেনের ভগ্নীপতি। তারা ভারত বিভক্তির পর চলে আসেন ভারতে।
আন্দোলন দমন করার জন্য ১৯৪৭ সালের ২ ফেব্রæয়ারী ঠাকুরগাওয়ের কালিবাড়ি রাস্তার ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। এতে ৫জন তেভাগা কর্মী শহীদ হয়েছিরেন। তারা ফুলবাড়ী থেকে বীরগঞ্জ হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল তেভাগার দাবীতে মিছিল নিয়ে রানীশংকৈল যাওয়ার। কিন্তু তার আগেই গুলিবর্ষনের ঘটনা ঘটে। গুলির করার দৃশ্য কালিবাড়ির পাশে অবস্থিত নিজেদের বাগান থেকে নিজে দেখেছেন দিলীপ ঘোষ।
অবশ্য দিলীপ ঘোষ তেভাগা আন্দোলন দেখলেও নিজে এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে অকপটে স্বীকার করলেন। তবে তিনি জানালেন যে, তার ছোট বোন শ্নেহকনা সিংহ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তিনি গুপ্ত পার্টির শুরু থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে কাজ করতেন। অস্ত্র বহন করতেন। শ্নেহকনার সাথে বানী ও ক্ষমা সেন নামে আরো দুজন নারী যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে।
দিলীপ ঘোষ নিজে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তখন তিনি ঠাকুরগাঁও হাই স্কুলে ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দলমত নির্বিশেষে, হিন্দু-মুসলিম সবাই মিছিল করতেন। সেখানে মিছিল সংগঠিত করতেন মূলত কমিউনিষ্ট পার্টির ছেলেরা। ছাত্ররাই সব করতেন। মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন ফজলুর রহমান মোক্তার (ঠাকুরগাঁও), আবু হোসেন (বোদা), মনসুর আলী (গড়েয়া) প্রমুখ। মিছিল হাই স্কুল হতে বেরিয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করত। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন হলেন দিলীপ নারায়ন ঘোষ, ঠাকুরগাঁও হাই স্কুলের তৎকালীন হেড মাষ্টার ফইমউদ্দিন আহম্মেদ এর ছেলে মোঃ ডালিম, বলরাম গুহ ঠাকুরতা, মোঃ ইসাহাক (কালিবাড়ি), আব্দুল মাজেদ (কালিবাড়ি), হুমায়ুন কবির (সালন্দর), প্রণব কুমার গুপ্ত পুনু (জমিদার কাচারি সংলগ্ন), খয়রুল হক মোক্তার (দৌলতপুর-বর্তমান নিবাস ঠাকুরগাঁও আশ্রমপাড়া) প্রমুখ। মিছিলে মেয়েদের অংশ গ্রহণ না থাকলেও ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ছিল।
ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালের ১৫ নভেম্বর দিলীপ ঘোষ ঠাকুরগাঁও ছেড়ে ভারতবাসী হন। বিরল রেল স্টেশন দিয়ে ভারতে আসার জন্য রওনা হয়েছিলেন । কিন্তু ট্রেনের বয়লার বাষ্ট হওয়ায় তাদের পুরো পরিবার আবার দিনাজপুর শহরে গিয়ে হিলি দিয়ে ভারতে ঢুকেছিলেন।

মহানন্দার শিলিগুঁড়ি :
১৫-৬-১৫ : আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে গোসল করে নিয়েছি। তারপর নাস্তা করেছি সকাল ৯টার মধ্যে। নাস্তা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু পিংকি কিছুতেই নাস্তা না খেয়ে আসতে দেবেন না। তার একটাই কথা, জুয়েল মামা প্রথম এসেছেন। তিনি আর আসতে পারবেন কি না কে জানে। তাই কিছু না কিছু খেতে হবেই। অতঃপর চা নাস্তা খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম সকাল ১০টার দিকে। পিংকি বার বার করে বললেন, রায়গঞ্জে এলে অবশ্যই যেন তাদের বাড়িতে আসি।

শিলিগুঁড়ি রেল স্টেশন

একটি অটো রিক্সায় বাস টার্মিনালে পৌঁছাতে ভাড়া নিল ২০টাকা। সেখানে স্টেটবাসে উঠে রওনা দিলাম শিলিগুঁড়ির উদ্দেশে। রায়গঞ্জ হতে গাড়ি রওনা দিয়ে নাগর নদী সংলগ্ন রায়গঞ্জের বিলাসপুর, করনদিঘী থানার চুন্ডিদিঘী ও দো-মোহনা, ডালখোলা হয়ে যে জায়গায় গেল, সেটা বিহার রাজ্যের আওতাভুক্ত, কিশনগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ড। এর অবস্থান বিহারে। এরপর পশ্চিম বাংলার গাইসাল, পান্ডেনগরের ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুরের সোনাপুরহাট, বিধানগর, দার্জিলিং জেলার ঘোষপুকুর, বাগডোগরা হয়ে শিলিগুঁড়ির কদমতলা এলাকা, যেখানে সুদর্শন মহানন্দা সেতু রয়েছে। সন্ধ্যায় সেখানে এসে থেমে গেল বাস।
ভারতীয় মেয়েরা বাসে, ট্রেনে ছেলেদের পাশে নিঃসংকোচে বসে এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। রায়গঞ্জ থেকে শিলিগুড়ি আসার পথেও একজন সুন্দরী মহিলাকে সহযাত্রী হিসেবে পেলাম যিনি প্রায় দুই ঘন্টার মত আমার পাশে বসে ছিলেন। চলতে চলতে আলাপ করেছি তার সাথে। তার নাম পলি মিত্র ব্যানার্জী। পশ্চিম বাংলার একজন স্বাস্থ্য কর্মী। বাড়ি থেকে কর্মস্থলে প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন এবং স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ভালই বেতন পান বলে জানালেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় রায়গঞ্জ হতে রওনা দিয়েছিলাম। কোথাও কোন জ্যাম ছিলনা। কিন্তু দুপুর সাড়ে ১২টায় বাস যখন ডালখোলা এলাকা অতিক্রম করছিল তখন প্রচন্ড জ্যামের কবলে পড়লাম। সেই জ্যাম কাটতে লাগে আধা ঘন্টার বেশি। প্রচন্ড গরমে ডিমসিদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা ছিল তখন।
কিষানগঞ্জ হলো পশ্চিম বাংলা ও বিহার প্রদেশের সীমান্ত এলাকা। এখানে চতুর্মুখী ওভার ব্রীজ আছে। ওভার ব্রীজের উপর দিয়ে ট্রেন ও বাস এক সাথে চলাচল করতে পারে। এখানকার বিভিন্ন দোকানপাটের সামনে যে সব সাইন বোর্ড আছে সেগুলো হিন্দিতে লেখা। কোন কোন সাইনবোর্ড হিন্দি, বাংলা ও উর্দুতে। এর থেকে বোঝা যায় এখানে বাংলা ও উর্দু দুই ভাষা-ভাষি লোকের আধিক্য আছে।
মহানন্দা সেতু মূল ভূমি থেকে অনেকটাই উঁচু। ব্রীজের দুই কিনারের তলদেশে অনেক দোকান-পাট। বেশ কিছু হোটেলও দেখতে পেলাম। এর একটিতে খাওয়া সেরে নিলাম। এখানে আবাসিক হোটেল কোথায় আছে তা খাওয়ার হোটেলের লোকজনের কাছ থেকে জেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম। তারা জানালেন যে, শিলিগুড়ি রেল স্টেশনের কাছে আছে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ঠিকানা তারা দিলেন।
খাওয়া সেরে আমি রিক্সা নিলাম। রিক্সা নিয়ে কয়েকটি হোটেলে গিয়ে খোঁজ খবর নিলাম। ভাড়া বেশি। শেষ পর্যন্ত শিলিগুঁড়ি রেল স্টেশনের সামনা-সামনি একটি দোতলা আবাসিক পেলাম, মোতি হোটেল। ভাড়া ২০০ টাকা। আহামরি কিছু না হোটেলটি। রায়গঞ্জের আনন্দ হোটেল এর চেয়ে ঢের ভাল। তবুও সেখানেই উঠলাম। কোন রকমে রাত কাটানো গেলেই যেন হলো।
হোটেলে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে, গোসল সেরে রাত ৮টার দিকে বাইরে এলাম। সারাদিন গাড়িতে বসে থাকায় হাত-পা অবশ হয়ে এসেছে। একটু হাঁটা দরকার। তাই হাঁটা শুরু করলাম সেদিকেই, যে দিক দিয়ে মহানন্দা সেতু। আবারো মহানন্দা সেতুর দিকে! কেন? দেখার জন্য। কিছুক্ষণ আগে এই সেতু রিক্সায় পার হয়েছিলাম। তখন সেটা ভালমত দেখা হয় নাই। এখন এর উপর দিয়ে হাঁটব ভেবেই হাঁটা শুরু করলাম সেতুর দিকে।
রেল স্টেশন হতে মহানন্দা সেতু কাছেই। আধা কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশি দূরত্বের হতে পারে। সেতুর দিকে যাওয়ার পথে ছোট্ট একটা পার্কের মত রয়েছে যেখানে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আবক্ষ মুর্তি আছে। আমি যখন পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম, সেই সময় দেখি জয়পুরহাটের সাংস্কৃতিক কর্মী আমিনুল ইসলাম বাবুল রিক্সায় চেপে যাচ্ছেন। আমি তাকে ডাকতে চাইলাম। কিন্তু কিছুতেই তার নামটা মনে করতে পারছিলাম না। তাকে এই যে ভাই বলে ডাকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রিক্সা ততক্ষনে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। ফলে ডাক দিলেও তিনি বুঝতে অথবা শুনতে পারলেন না।
মহানন্দা নদী বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ায় এবং চাঁপাই নবাবগঞ্জে দেখেছি। আজ ভারতে দেখলাম। বাংলাদেশে থাকা এ রকম আরো কয়েকটি নদী এর মধ্যে দেখা হয়েছে ভারতের ভিতরে। এর মধ্যে আছে পুনর্ভবা, আত্রাই, তালমা, টাঙ্গন।
মোতি হোটেলে এসে গৌতম নামের একজনকে ফোন দিয়েছিলাম, যিনি এক সময় বাংলাদেশে দিনাজপুরের চকবাজারে বসবাস করতেন। চিত্তদার বাড়ির পাশেই বাড়ি ছিল। তার সাথে রায়গঞ্জের আশিষের পরিচয় আছে। আশিষ গতকাল গৌতমকে মোবাইলে আমার কথা জানিয়ে বলে দিয়েছিলেন যে, জুয়েল মামা শিলিগুঁড়ি যাচ্ছে। সেখানে যতক্ষণ থাকবে, তুমি তার খেয়াল রাখবে।
গৌতম আমার ফোন পেয়ে রাত ৯টার দিকে স্টেশন এলাকায় চলে এলেন। তার চেহারা গোল-গাল, নাদুস-নুদুস। সব সময় হাঁসি হাঁসি মুখ। প্রায় এক ঘন্টা সময় কাটালেন আমার সাথে। তিনি জানালেন যে, দিনাজপুরে কিশোরী ইয়াসমিনকে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে যে গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেই আন্দোলনে সামিল ছিলেন তিনি। রামনগর মোড় থেকে মিছিল নিয়ে কোতয়ালী থানা ঘেরাও করতে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। তার সাথে সর্দার পাড়ার রফিকুল ইসলাম, খোকা সহ আরো কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের সবাইকে কারাগারে নেয়া হয়। তখন ৩-৪ দিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছিল। ঐ ঘটনায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে কয়টি মামলা দায়ের করেন, তার একটিতে তাকেও আসামী করা হয়েছিল। ঘটনার এক বছর পর ঐ মামলায় পুলিশ আবারো তাকে গ্রেফতার করে। তখনো ৩-৪ দিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছিল।
গৌতমের এ ঘটনা জানার পর আমি আমার লেখা ইয়াসমিন আন্দোলন বইটি ঘাঁটলাম। সেখানে আসামীর তালিকায় সত্যি সত্যিই তার নাম পেলাম। আমি বললাম, মামা, তুমি তো ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়ে গেছ! তোমার কথা আমি আমার বইয়ে লিখেছি অথচ তোমাকে চিনতাম না, আজ চিনলাম।
আমার কথায় গৌতম হাঁসলেন। জানতে চাইলাম, মামলার কারণেই সে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছে কি না?
গৌতম জানালেন যে, সেই কারণে তিনি আসেননি। তার বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দিনাজপুর শহরের গনেশতলা এলাকায় গুলিস্তান কাপড়ের দোকানের সামনে তার পিতা বিনোদ ঘোষের একটি টেইলার্সের দোকান ছিল, নাম ওয়েলফিট টেইলার্স। সেখানে ভালই ব্যবসা হতো। কিন্তু হঠাৎ করে এই ব্যবসাটা নষ্ট হয়ে গেলে তারা আর্থিক সংকটে পড়েন। তখন তিনি ইন্ডিয়া চলে আসেন এবং পানির লাইন মেরামতের কাজ শুরু করেন। এখন তার পেশা হলো পানির লাইন মেরামত করা। আলাপকালে গৌতম তড়কা, রুটি , চা খাওয়ালেন। এতে তার খরচ হলো ৬০ টাকা। বিল আমি দিতে চাইলেও গৌতম কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি দোকানীকে ইশারা করলেন, আমার কাছ থেকে যেন বিল নেয়া না হয়।
আলাপ শেষ করে গৌতম চলে গেলেন। বলে গেলেন, যে কোন সমস্যা হলেই আমি যেন নিঃসংকোচে তাকে তা জানাই। তিনি কাল আবার আসবেন বলে জানালেন। তার আগে তার কাছ থেকে দার্জিলিং যাওয়ার উপায় জেনে নিলাম। আমিও হোটেলে গিয়ে রাত প্রায় ১১টার দিকে শুয়ে পড়লাম।

মেঘ-পাহাড়ের দার্জিলিং :
১৬-৬-১৫ : ভোর ৫টার দিকে ঘুম ভাঙ্গল। দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম অন্ধকার রয়ে গেছে। কিন্তু দার্জিলিং যাব বলে কথা। তাই প্রস্তুতি শুরু তখন থেকে। দাঁত মাজা, হাত-মুখ ধোয়া, কাপড় পড়া শেষ করে সাড়ে ৫টার দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম। তখন দিনের আলো যথেষ্ট ফুটে উঠেছে। সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। লোক চলাচল রয়েছে প্রচুর। তাই বাইরে বের হতে কোন ভয় হলো না।
শিলিগুঁড়ি রেল স্টেশনের সাথেই রয়েছে বাস টার্মিনাল। এখান থেকে বিভিন্ন রুটে গাড়ি চলাচল করে। শ্রমিকরা হাঁক-ডাক করছিলেন কুচবিহার, জলপাইগুঁড়ি, কলকাতা, রায়গঞ্জ …।
আমি খুঁজলাম দার্জিলিংয়ের গাড়ী। সেটাও পেয়ে গেলাম কয়েক কদম দূরে। দার্জিলিং দার্জিলিং বলে হাঁক দিচ্ছিলেন কিছু শ্রমিক, যারা এক ধরনের জীপ এর ড্রাইভার অথবা হেলপার। এই জীপ আমি বাংলাদেশের বান্দরবানে দেখেছি অনেক আগে। সেখানে এগুলোকে ‘চাঁন্দের গাড়ি’ বলা হয়। ঐ জীপে উঠে বান্দরবান শহর থেকে চিম্বুক পাহাড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আমার। সেই জীপ আর এই জীপগুলোর মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। চাঁন্দের গাড়ী মার্কা জীপগুলো অনেক পুরনো। অনেকটা লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। পাহাড়ে উঠে কঁকিয়ে কঁকিয়ে। কিন্তু এখানকার জীপগুলো বেশ পরিপাটি, অনেকটাই নতুন এবং অভিজাত। একজন জিজ্ঞাসা করলেন : দাদা, দার্জিলিং যাবেন?
বললাম : যাব তো, কত ভাড়া আপনাদের?
উত্তর পেলাম : ১৩০ টাকা।
১৩০ টাকা শুনে অবাক হলাম। মাত্র ১৩০! বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমান দাঁড়ায় ১৫৫ টাকার মত। এই টাকায় দিনাজপুর থেকে গাইবান্ধায়ও যাওয়া যায় না। অথচ শিলিগুঁড়ি থেকে দার্জিলিং! আমার জানামতে এখান থেকে দার্জিলিং প্রায় ৪ ঘন্টার পথ। তদুপরি পাহাড়-পর্বতের রাস্তা। সে তুলনায় ভাড়া মোটেও বেশি বলে মনে হলোনা। তবুও দর করার চেষ্টা করলাম, যদি কিছু কমানো যায়। কিন্তু গেল না। এটা এখানকার ফিক্সড ভাড়া। যে গাড়িতেই যাই না কেন, ভাড়া একই।
দার্জিলিংগামী যাত্রী দেখলাম ভালই। অল্প সময়ের মধ্যে পুরো জীপ ভর্তি হয়ে গেল। সকাল ৬টার দিকে রওনা দিল জীপটি। সম্ভবত ১০-১২ কিলোমিটারের মত রাস্তা ছিল সমতল ভূমির উপর। তারপর ক্রমাগতভাবে পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড় যত পেরিয়ে যেতে থাকে গাড়ি ততই উর্ধমুখি হতে থাকে। সেই সাথে রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে বসন্তের বাতাসের মত মনের মধ্যে দারুন এক ভাল লাগা বোধ আসতে থাকে।

দার্জিলিং রেল ষ্টেশন

দার্জিলিং হলো একটি পাহাড়ী জেলা। পাহাড়ের পর পাহাড়। পাহাড়ের উপরে পাহাড়। পাহাড়ের নীচে পাহাড়। মাইলের পর মাইল শুধুই পাহাড়। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড় ভেদ করে আমাদের গাড়ি আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে যেতে থাকে। গাড়ি এত উপরে উঠে যে, গাড়ির ভিতর থেকে বাইরে তাকালে ভয় লেগে যায়। রাস্তার নীচে পাহাড়ি ঢাল দেখে ভয় না এসে উপায় নেই। ঢাল চলে গেছে কত নীচে! এই ঢালে যদি গাড়ি ¯িøপ কেটে পড়ে যায়, তাহলে লাশও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
দার্জিলিং যাব জেনে গতকাল গৌতম পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেখানে যাওয়ার সময় সোয়েটার নিয়ে যেতে। কারণ সেখানে শীত করবে। কিন্তু সোয়েটার পাব কোথায়? আমি কোন গরম কাপড় আনিনি। যখন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম আবহাওয়া অনেক গরম ছিল। শীতের কাপড় নেয়ার প্রয়োজন হয়নি। এখন একটা মাত্র দিনের জন্য ৫-৭শ’ টাকা খরচ করে সোয়েটার কেনাও সম্ভব নয়। তবে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় একটি ব্যাগের মধ্যে বেশ কিছু কাপড় নিয়েছিলাম শীত লাগলে পড়ে নিব ভেবে ।
পরে দেখেছি দার্জিলিংয়ের দিকে গাড়ি যত এগিয়েছে ততই শীতের অনুভূতি বেড়েছে। রোদ্রোজ্জল আকাশ, মাঝে মাঝে ভাসমান মেঘ, এই মেঘ কোথাও উপর দিকে, কোথাও নীচের দিকে, কোথাও সামনের দিকে। আবার মাঝে মাঝেই রাস্তা ভেজা ভেজা দেখেছি। এর কারন জানতে চাইলে একজন জানালেন যে, রাস্তার উপর দিয়ে মেঘ ভেসে গেছে।
গাড়ির ভিতরে আছি, তবুও শীতের অনুভূতি ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া ছাড়া কমার দিকে আসেনি। পাহাড়ি রাস্তায় মাঝে মাঝে লোক দেখা যাচ্ছিল। তাদের প্রত্যেকের গায়ে সোয়েটার, কোট ইত্যাদি গরম কাপড় পড়া ছিল। তাদেরকে দেখে আমার মধ্যেও যেন শীতভাব বেড়ে যায়। আমি গেঞ্জির উপরে আরেকটি গেঞ্জি পড়ে নেই।
সকাল ১০টার পর গাড়ি দার্জিলিং শহরে গিয়ে পোঁছাল। সমতল ভূমি হতে ৬ কিলোমিটার বা ৪ মাইল উঁচু পাহাড়ের উপর গড়ে তোলা হয়েছে এই শহর। যখন গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়ালাম তখন শীত অনুভূতি আরো প্রবল হয়ে উঠল।
বাংলাদেশের দিনাজপুরে প্রবল শীতের সময় যে অনুভূতি আমরা পেয়ে থাকি, সে রকম শীতের অনুভূতি এখানে। অথচ এই মুহুর্তে শিলিগুঁড়িতে গরম চলছে। রায়গঞ্জ সহ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে গরমের তীব্রতা শিলিগুঁড়ির চেয়ে আরো বেশি। দার্জিলিংয়ের এই আবহাওয়া বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার অন্য এলাকার চেয়ে সম্পুর্ণ আলাদা। এখানে শীত, অন্যখানে গরম। আমার মন খারাপ হলো এই ভেবে যে, দুই বাংলা যদি এক থাকত অথবা দুই বাংলা মিলেই যদি বাংলাদেশ হতো তাহলে এই চমৎকার পাহাড়, নান্দনিক অনিন্দ্য সুন্দর এবং ভিন্ন আওহাওয়ার বৈচিত্র্যময় দার্জিলিং আমার দেশের অংশ হতে পারত। তাতে আমার দেশ আরো সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় রুপে রুপায়িত হয়ে গোটা দুনিয়ার জন্য অন্য রকম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হতে পারত এবং পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া যখন তখন এর সৌন্ধর্য উপভোগ করার জন্য এখানে আসতে পারতাম। কিন্তু কপাল পোড়া বলেই হয়ত দার্জিলিং আজ আমাদের নয়। শুনেছিলাম যে, দেশ ভাগাভাগির সময় দার্জিলিং, কলকাতাসহ অনেক এলাকা পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা ছিল। এইসব এলাকায় দু-তিনদিন ধরে পাকিস্তানি পতাকাও উঠেছিল। কিন্তু সেই সময়ের মুসলিম লীগ নেতারা তাদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে কলকাতা কিংবা দার্জিলিংয়ের মত জায়গাগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা নিয়ে উদাসীন ছিলেন। ফলে সেগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে। যদি সেগুলো তখন পূর্ব পাকিস্তানের আওতায় আসত তাহলে আজ বাংলাদেশের থাকত।
দার্জিলিং পেঁৗঁছানোর আগেই আমার মধ্যে পায়খানার তীব্র চাপ এসেছিল। গাড়ি থেকে নামার পর এই চাপ যেন মুহুর্তের মধ্যে দ্রæতগতি হয়ে উঠল। বেকায়দা কিছু হওয়ার আগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও টয়লেট আছে কি না, খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু আশপাশ দেখে বিষয়টা বুঝতে পারলাম না। তাই লোককে জিজ্ঞাসা কররাম, টয়লেট কিধার হ্যায়?
ভারতে ধোকার পর এই প্রথম আমি হিন্দি ভাষায় (হিন্দি না উর্দু হলো সঠিক জানি না) সরাসরি কাউকে কোন প্রশ্ন করলাম। এখানে আসার আগে শুনেছিলাম যে, দার্জিলিংয়ে তুলনামূলকভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার কম। এখানে নেপালী লোক বেশি থাকেন। নেপালী ও হিন্দী ভাষার প্রচলন এখানে বেশি। আমার প্রশ্নে একজন দেখিয়ে দিল, উধার উধার। ওহি গেট হ্যায় না, উভি পাবলিক টয়লেট হোতা হ্যায়।
কথা শুনে জানে যেন প্রান ফিরে পেলাম। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটিকে প্রশ্ন করছি, তার থেকে ১০-১২ কদম দূরেই টয়লেট। লোকটির দেখানো গেট দিয়ে আমি দ্রæত সেখানে ঢুকলাম। কিন্তু সেখানে ঢুকেই আক্কেল গুড়–ম!
এ কি অবস্থা? সেখানে দুই সারিতে ১০-১২টি টয়লেট আছে। কিন্তু কোনটারই দরজা নাই। দরজাবিহীন প্রত্যেকটি টয়লেটে লোক বসে আছেন মাথা নীচু করে। তারা পায়খানা সারছেন আর নিজেদের গোপন অঙ্গের সামনে দুই হাত জোড় বেঁধে রেখেছেন। দু হাত দিয়ে গোপনাঙ্গ আড়াল করছেন। এই দৃশ্য আমাকে তাজ্জব করে দিল। এভাবে পায়খানা করতে আমাদের দেশের মানুষ বর্তমানে অভ্যস্ত নয়। আর আমার পক্ষে এটা এক অচিন্তনীয় বিষয়। কিন্তু তখন আমার অবস্থা এমন যে, যে কোন অবস্থাতেই শুচিকর্ম সারতে হবে।
আমি সবগুলো টয়লেটেই লোক বসে থাকতে দেখলাম। ফলে ৫-৭মিনিট অপেক্ষা করতেই হলো। এরপর একটিতে বসে শুচিকর্ম সারতে থাকি তাদের মত করেই, যাদেরকে এর আগে দেখেছি। শুচিকর্ম সারার সময় আমার সামনে দিয়ে ৮-১০ জনকে দেখলাম যাতায়াত করতে। তাদের কেউ শুচিকর্ম সারার জন্য ফাঁকা টয়লেট খুঁজছেন, কেউ টয়লেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। তারা আমাকে দেখছেন যে, আমি শুচিকর্ম সারছি। আমি তখন লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম এভাবে এটা সারতে। কিন্তু ভরসা ছিল যে, এই লোকেরা কেউ আমাকে চেনেন না। আমিও তাদের কাউকে চিনি না। জানি না, দার্জিলিংয়ের মানুষেরা সবাই এভাবেই শুচিকর্ম সারেন কিনা। এরপর আর জানার সুযোগও হয়নি। তবে এই আধুনিক যুগে বিষয়টি আমার মোটেও ভাল লাগেনি। টয়লেট সেরে যেন এক মহাবিপদ থেকে বাঁচা গেল।
টয়লেট থেকে বাইরে এসে শীতের অনুভূতিটা আরেকটু বেশি হতে লাগল। যে কাপড় পরেছিলাম তা দিয়ে শীত যাচ্ছিল না। ফলে আমার লুঙ্গি ব্যাগ থেকে বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। শীত কিছুটা কমে এলো। তারপরেও যথেষ্ট শীত লাগছিল। তখন ভাবলাম যদি হাঁটাহাঁটি করি তাহলে শরীর গরম হয়ে উঠবে। দার্জিলিং দেখা হবে, শীতও লাগবেনা।
রাস্তার দু-পাশে অনেক দোকান আছে। তখনো সেগুলো খোলেনি। যদি কোন দোকান থেকে এক-দেড়শ’ টাকার মধ্যে সোয়েটার পাই তাহলে কিনে নিয়ে গায়ে চড়াব এমন একটা ভাবনা মাথায় এলেও দোকান-পাট বন্ধ থাকায় কার্যকর করা গেল না। শীত দূর করতে তাই হাঁটতে থাকি। হাঁটার সাথে সাথে চলে ছবি তোলা। সবগুলোই সেলফি। নিজের ছবি নিজেই তুলি। প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটার পর দেখি রাস্তার পাশে চায়ের দোকান নিয়ে বসেছেন এক মহিলা। মহিলার বয়স হতে পারে ২৬-২৭। ধবধবে ফর্সা। অনেকটা বালেয়া মাছের মত চেহারা। মন খুশিতে ভরে উঠে চা দোকান দেখে।
এই শীতের মধ্যে চা হলো আমার সবচেয়ে অপরিহার্য ও পছন্দের পানীয়। আমি একজন এজমা রোগী। ছোট বেলা থেকে আক্রান্ত এই রোগে। রোগকষ্ট থেকে দূরে থাকতে নানান সতর্কতা মেনে চলার চেষ্টা করি। এই চেষ্টার অংশ হলো গরম পানিতে গোসল সারা, শীতকালে গরম পানি খাওয়া, গরম পানি না পেলে চা খেয়ে শরীর গরম করা ও পানির প্রয়োজনীয়তা দূর করা। শীতের সময় সাধারনত আমি গরম পানি খেয়ে থাকি। কোনভাবেই ঠান্ডা পানি পান করি না। পানি না পেলে চা খাই। বালেয়া মাছের মত ধবধবে ফর্সা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম : লাল চা হোগা?
মহিলা বললেন : হোগা হোগা।
: কিতনা রুপিয়া?
: দশ রুপায়া?
দশ রুপায়া কথাটা শুনে ভাবলাম, এত দাম? বাংলাদেশি টাকায় এটা প্রায় ১৩ টাকার সমান। কিন্তু এক কাপ চা নিয়ে তো দরাদরি চলেনা। তাই বললাম : দিজিয়ে।
মহিলা বেশ বড় সাইজের একটি কাপে চা বানিয়ে দিলেন। চা খেয়ে মনে হলো ১০টাকা ফালতু খরচ হচ্ছেনা। চা যেমন টেষ্টি তেমনি পরিমানেও বেশি।
গরম চা মুখে দিতে দিতে মহিলার সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করি : আপ দার্জিলিংমে র‌্যাহেতে হ্যায়?
হু বলে মহিলা চুপ। বেশি কথা পছন্দ করেন না মনে হলো। তবু প্রশ্ন করি : দার্জিলিংমে কিতনা দিন সে র‌্যাহেতা হ্যায়?
: ইয়ে হামারা জন্মস্থান। লেকিন হামারা মাই, বাপ নেপাল সে আয়া হ্যায়।-বলেন মহিলা।
এরকম নানান কথার এক পর্যায়ে মহিলা আমাকে প্রশ্ন করেন : আপ কাঁহাসে আয়া হ্যায়?
আমি জানালাম যে, আমি দিনাজপুর থেকে এসেছি। বাংলাদেশকা দিনাজপুর।
যখন দিনাজপুর বলেছি, তখন মহিলার তেমন কোন ভাবান্তর দেখিনি। কিন্তু বাংলাদেশ বলার সাথে সাথে মনে হলো, মহিলা খুশি হলেন না। কেমন যেন মুখ ভেংচিয়ে বললেন : ও আপ বাংলাদেশকা আদমি হ্যায়? বাংলাদেশকো সাথ হামারা কোই লেনদেন নেহি হ্যায়।
মহিলার কথার ধরনে বুঝলাম তিনি বাংলাদেশ পছন্দ করেন না। তার কথায় সেখানে থাকা এক যুবক তাকে বলললেন : এ্যাইসা বাত নেহি করতা হ্যায়।

নেপালী বংশোদ্ভূত দার্জিলিংয়ের চা ওয়ালী

কিন্তু মহিলা সেকথা শুনলেন না। যা হোক, মহিলার সাথে আলাপ আর জমল না। মন একটু খারাপ করে চায়ের দাম দিয়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে কিছু ছবি তুলে তুললাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে দার্জিলিং জেলা জজকোর্ট, দার্জিলিং কলেজ, স্কুল, রেলস্টেশন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। এই সব প্রতিষ্ঠান সহ বিপুল সংখ্যক বাড়ি-ঘর গড়ে উঠেছে দার্জিলিং শহরে। ৪ তলা, ৫ তলা ভবন কিভাবে ঢালু, উঁচু, এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে তা আমাকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তোলে। পাহাড়ের বুকে রেলগাড়ীও চলাচল করে যা যথেষ্ট বিস্ময়ের বলে আমার কাছে মনে হয়।
বিকাল ৪টা পর্যন্ত দার্জিলিংয়ে ঘুরে বেড়াই। এরমধ্যে একটি হোটেলে বসে খাওয়াও সারি। এখানেও একজন মহিলা খাইয়েছেন। দার্জিলিংয়ের অধিকাংশ দোকান চালায় মহিলারা। সেটা হোটেল হোক আর সাধারণ ভ্যারাইটি ষ্টোর্স হোক। সবখানে মহিলাদের রাজত্ব। তারাই সর্বময় কর্তা। মেয়েদের এই অগ্রগতি ভাল লাগল। বাংলাদেশের মেয়েরা অতি সম্প্রতি ব্যবসা-বানিজ্য শুরু করেছেন। কিন্তু দার্জিলিং পর্যায়ে আসতে এখনো অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে।
শহরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে বিকাল ৪টার দিকে আবার সেই স্থানে এসে উপস্থিত হই, সকালে যে জায়গায় নেমেছিলাম। তখন জেনে নিয়েছিলাম যে, যদি আমি শিলিগুঁড়ি ফিরে যেতে চাই তাহলে বিকাল ৪টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। তাহলে গাড়ি পেতে সমস্যা হবে না। এর চেয়ে বেশি দেরী হলে গাড়ি পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা বলা মুশকিল। আমিও অনিশ্চয়তা থেকে দূরে থাকার জন্য ঠিক বিকাল ৪টার মধ্যে ফিরে এসে শিলিগুঁড়িগামী জিপে উঠে পড়লাম।
দার্জিলিংয়ে মেঘ বৃষ্টি রোদের খেলা। যতক্ষণ ছিলাম একটা জিনিষ দেখতাম যে, বিভিন্ন গাছ-গাছালির ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। প্রথমে মনে হয়েছিল আগুন লেগেছে। লোককে ধোঁয়া দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম : আঁগ লাগ গ্যায়া ক্যা?
লোক বলেছে : আঁগ নেহি, মেঘ হ্যায়।
জানলাম যে, এই ধোঁয়াগুলো আসলে মেঘ। দার্জিলিংয়ে মেঘ ভেসে বেড়ানো একটা সাধারণ বিষয়। যারা জানেন না, তারা মনে করবেন, আগুন লেগে ধোঁয়া উড়ছে। কিন্তু যারা জানেন, তারা ধোঁয়া দেখে বুঝবেন ওটা আসলে মেঘ। এখানে মেঘ গাছ-গাছালিতে ভেসে বেড়ায়, রাস্তার উপর দিয়ে ভেসে বেড়ায়, ভেসে ভেসে বিভিন্ন বাড়ি-ঘরে ঢুকে কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে দেয়। এ কারণে এখানকার সব বাড়ির জানালা প্রায় সর্বক্ষণ লাগিয়ে রাখা হয় যেন মেঘ ঘরের ভেতরে ঢুকতে না পারে।
দার্জিলিং যাওয়ার সময় আকাশ পরিস্কার ছিল। অনেক পাহাড় দেখা গেছে। কিন্তু ফেরার সময় মেঘের আড়ালে সব পাহাড় ঢাকা পড়ে যায়। যাওয়ার সময় অনেক স্থানে রাস্তা ভেজা পেয়েছিলাম। ফেরার সময় কোথাও কোথাও বৃষ্টি পেলাম। কোথাও কোথাও মেঘের ভিতর দিয়ে আমাদের গাড়ি ধীর গতিতে অতিক্রম করল।
ফেরার পথে ঘন্টা দুয়েক চলার পর গাড়ি রোহিনী নামে একটি জায়গায় এসে থামে। এখানে পাহাড়ের একটি অংশ কিছুটা সমতলের মত করে হোটেল করা হয়েছে। সেখানে অনেকে খাওয়া-দাওয়া করলেন। আমিও পুরি সদৃশ্য এক প্রকার খাওয়া খেলাম। দাম নিল ৩০ টাকা। বেশ মজা পেলাম এই খাবার খেয়ে। এরপর আবার গাড়ি রওনা দিয়ে রাত ৮টার মধ্যে শিলিগুঁড়ি এসে পৌঁছাল।
শিলিগুঁড়িতে পৌঁছানোর অল্পক্ষনের মধ্যে এসে হাজির হলেন গৌতম। তিনি তার মটর সাইকেলে তুলে নিয়ে আমাকে শহর দেখাতে বের হলেন। মটর সাইকেলে চলতে চলতে তিনি জানালেন যে, শিলিগুড়ি শহর একটি সিটি কর্পোরেশন এলাকা। এই সিটি কর্পোরেশন গড়ে উঠেছে শিলিগুঁড়ি ও জলপাইগুঁড়ির জায়গার ওপর। এই কর্পোরেশন দার্জিলিং জেলার আওতায় থাকলেও এর কিছু কিছু ওয়ার্ড জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে হায়দারপাড়াও আছে। এ পাড়াতেই বাড়ি গৌতমের। পাড়াটি জলপাইগুড়ি জেলাধীন শিলিগুঁড়ি মহকুমার আওতাভুক্ত। আমার কাছে বিষয়টি বেশ জটিল জটিল মনে হলো। একই সিটি কর্পোরেশনের কিছু এলাকা দার্জিলিংয়ের, কিছু আবার জলপাইগুঁড়ির। ব্যাপারটা যেন কেমন। রহস্য রহস্য ভাব।
গৌতম মহানন্দা ব্রীজ পার হয়ে সেবক রোড ধরে একটি ইস্কন মন্দিরের পাশ দিয়ে হায়দারপাড়ায় তার নিজের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে পরিচয় হলো তার স্ত্রী বাসনা ঘোষ ও ছেলে প্রীতম ঘোষের সাথে। প্রীতম স্কুলে পড়ে। বাসনা নব প্রসূত সন্তান নিয়ে আমার জন্য চা করলেন। আমাকে ভাত খেয়ে যেতে বললেন এবং একথাও বললেন যে, কোন অসুবিধা না থাকলে আমি এখানেই থেকে যেতে পারি। কিন্তু আমি দেখলাম বাড়িটি ছোট। বোঝা যায় এখানে কিছুটা কষ্টের মধ্যে থাকেন গৌতম। কষ্ট হলেও এ বাড়ি তার নিজের। বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে তিনি বাড়ি করতে পেরেছেন এটা একটা বিরাট ব্যাপার। আর কার্টিসি জানিয়ে তার স্ত্রী ভাত খেতে বললেও আমি রাজি হলাম না। কারণ আমি দেখলাম গৌতমের স্ত্রী প্রসূতি জনিত কারণে অসুস্থ্য। এই অসুস্থ্য শরীরে আমাকে চা খাওয়ালেন এটাই আমার জন্য বড় ব্যাপার বলে মনে হলো।
কিছু গল্প-স্বল্প করে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। গৌতম এরপর আমাকে নিয়ে গেলেন সেবক রোডের একটি মটর সাইকেল মেরামতের দোকানে। সেখানে আলাপ হলো দুলাল দাস, প্রদীপ রায় ও স্বদেব নামের তিন তরুণের সাথে। এরপর আরেকটি দোকানে আলাপ হলো অলীক নামের এক তরুণ ও তার ভাইয়ের সাথে। গৌতম সবার কাছেই আমার পরিচয় তুলে ধরলেন এভাবে যে, আমি তার মামা হই, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, বাংলাদেশের দিনাজপুরে থাকি, আমি সেখানকার একজন বড় সাংবাদিক, অনেক বই লিখেছি ইত্যাদি। তারা আমাকে চা পান করিয়ে আপ্যায়িত করলেন। এরপর ফিরে এলাম হোটেলে। এসেই ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লাম।

জলপাইগুড়িতে তিস্তার ধারে :
১৭-৬-১৫ : আজও ঘুম ভাঙ্গে সকাল সকাল। ঘুম থেকে উঠে কিছু ছবি তুলি। তারপর কুচবিহার যাব মনে করে সকাল ৭টায় গাড়িতে উঠি। কিন্তু গাড়িতে উঠে যখন শুনি যে, কুচবিহার যেতে অন্তত ৪ ঘন্টা লাগবে, তখন মত পাল্টিয়ে জলপাইগুড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ কুচবিহার যেতে ৪ ঘন্টা, আসতে ৪ ঘন্টা তাতে দিন পার। কিন্তু জলপাইগুড়ি যেতে এক ঘন্টার মত লাগবে বলে জানালেন বাস কন্ট্রাক্টর। চিন্তা করলাম জলপাইগুঁড়ি হলো বাংলাদেশের পঞ্চগড় সংলগ্ন জেলা। তাই এটা দেখে আসি। গাড়ীর কন্ট্রাকটর জানালেন, গাড়ি যাবে বাইপাস হয়ে। তাই গোঁশালা অথবা পাহাড়পুরে নামতে হবে।

জলপাইগুড়িতে নেতাজী সুভাষ ফাউন্ডেশনের সামনে

গাড়ী রওনা দেয়ার পর পৌনে এক ঘন্টার মত চলল। তাতেই গোঁশালা পৌঁছে গেলাম। আমি সেখানে নামলাম সকাল পৌনে ৮টার দিকে। গোঁশালা হলো একটি মোড়। চার রাস্তার মোড় এটা। মোড়টি অনেকটা অংকের গুণ চিহ্ন বা ইংরেজী বর্ণমালা ী এর মত। মোড়ের এক দিকে একটি সারস পাখির ভাস্কর্য। আরেকদিকে একজন কংস বাদকের ভাস্কর্য। এই দুই ভাস্কর্য কিছুটা আকর্ষনীয় করেছে মোড়টিকে। মোড়ের এক কোনে একজন মহিলা পুড়ি ভাজছিলেন। সেটা দেখে আমার ক্ষুধা পেয়ে গেল। পুড়ি আর চা পান করতে করতে ভাস্কর্যের সৌন্ধর্য উপভোগ করে নিলাম।
এরপর গোঁশালা থেকে একটি অটো গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম জলপাইগুড়ি শহরের দিকে। যাওয়ার পথে একটি নদী পেলাম যার নাম তালমা। এই নদী জলপাইগুঁড়ির ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ায় গেছে। এটা আমার জানা আছে কারণ তেঁতুলিয়ায় এই নদী আমার দেখা আছে।
অটোগাড়ি নিয়ে গেল জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনের কাছে। ভাড়া ২০ টাকা। সেখান থেকে হাঁটতে থাকি ইচ্ছেমত। নেতাজীপাড়া, কেরানীপাড়া, উকিলপাড়া, কদমতলা মোড় হয়ে চলে আসি করলা নদীর সেতুতে, যে সেতু ৬৯এর ভয়াবহ বন্যায় ভেসে যাওয়া অসংখ্য মানুষের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। সেতু পেরিয়ে সামান্য হেঁটে গেলে পাওয়া যায় জলপাইগুঁড়ি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন সরকারী কার্যালয়। এর পাশে আছে একটি বাঁধ, যা এখান থেকে করলা নদীকে তিস্তা নদী থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারীতে আমি তিস্তা নদী দেখেছি। আজ ভারতের মাটিতে এই নদী দেখলাম। নদীর পাশে একটি পার্ক রয়েছে। পার্কের কিনার দিয়ে বেশ কিছু পাকা বেঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছে দর্শনার্থীদের বসার সুবিধার জন্য। এর একটিতে প্রায় ঘন্টাখানেক বসে থেকে তিস্তা নদী দেখতে থাকলাম আর ভাবতে লাগলাম যে, এই নদীগুলো কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখের কারণ হচ্ছে।
তিস্তা পাড় থেকে যখন উঠলাম তখন টয়লেটের বেগ চলে এসেছিল। কোথাও সেটা সারতে হবে। জলপাইগুঁড়ি ভূমি অফিসে সেটা সেড়ে করলা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবুপাড়া, থানামোড় হয়ে কদমতলীতে গিয়ে শিলিগুঁড়ির বাস ধরলাম। শিলিগুঁড়ি গিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে কলকাতাকে টার্গেট করে আরেকটি বাস ধরে বিকাল ৪টার দিকে রওনা দিলাম রায়গঞ্জের উদ্দেশে।

রায়গঞ্জ-হেমতাবাদ-সমাসপুর :
১৮-০৬-১৫ : ভোর ৫টায় ঘুম ভাঙ্গল রায়গঞ্জের আনন্দ হোটেলে। টয়লেট সেরে বের হয়ে দেখি হোটেলের বাইরের দরজা তখনো বন্ধ। আরেকজন বোর্ডার এসেছিলেন গেটে। তিনিও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন বাইরে যাওয়ার জন্য। আলাপে জানা গেল তিনি শিলিগুঁড়ি থেকে এসেছেন, মালদা যাবেন। তিনি তার দুই হাত বার বার চুলকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন যে, শিলিগুঁড়িতে এত গরম নেই।
তার ডাকাডাকিতে কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলল একজন। তিনি গেট পেরিয়ে দ্রæত চলে গেলেন আর আমি বাইরে গিয়ে চা খেলাম। এরপর হাঁটতে হাঁটতে শিলিগুঁড়ি মোড় নামের একটি ব্যস্ততম জায়গা পার হলাম। এই মোড় থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায় বলে জায়গাটির নাম পড়ে গেছে শিলিগুড়ি মোড়। ঠিক যেমন বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে আছে ফুলবাড়ি বাসষ্ট্যান্ড। ফেরার পথে এক দোকানে মতিচুরের লাড্ডু, গজা, মিষ্টি খেলাম। বিদ্রোহী কবি নজরুল ও বিপ্লবী ক্ষুদিরামের সবাক মুর্তির সাথে কিছু ছবি তুললাম।
গতকাল রাতে বৈশাখী টিভির দিনাজপুর প্রতিনিধি একরাম তালুকদার আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি মোবাইলে বলেছিলেন যে, কালিয়াগঞ্জের সমাসপুরে তার ফুপুর বাড়ি রয়েছে। ফুপাত ভাই নওশাদ আলী কর্ণজোড়া হাইস্কুলের শিক্ষক। যদি তার ওখানে যাই তাহলে তিনি (নওশাদ) আমাকে যে কোন প্রয়োজনে সহায়তা করবেন। একরাম জানিয়েছিলেন, সমাসপুর হাট হলো হেমতাবাদ এর কাছাকাছি।
আমি যাব কলকাতা। রায়গঞ্জ রেল স্টেশন গিয়ে খবর নিয়ে জানলাম যে, এখান হতে কলকাতার গাড়ি পাওয়া যাবে সন্ধ্যায়। সন্ধ্যায় গাড়ি। তাহলে সারাদিন কি হবে? এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে কাটাতে হবে। ভাবলাম হেমতাবাদে যাই। এরপর সেখান থেকে সমাসপুরে যাব। সকাল ১০টায় আনন্দ হোটেল হতে হেমতাবাদ এর উদ্দেশে রওনা হলাম। খুব বেশি দূর নয়। ১০-১২ কিলোমিটার হতে পারে।
হেমতাবাদ হলো রায়গঞ্জের প্রশাসনিক এলাকা। যখন এখানে পৌঁছালাম তখন শুনলাম যে, আজ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে পশ্চিম বাংলার মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বৈঠক করবেন। এ নিয়ে হেমতাবাদে নিরাপত্তার কড়াকড়ি দেখলাম এবং লোকজনের মধ্যে কিছুটা উচ্ছাসের ভাব লক্ষ্য করলাম।
হেমতাবাদে ঘন্টাখানেক এদিক সেদিক ঘুরে একটি বাসে উঠে সমাসপুরের দিকে রওনা দিলাম। সমাসপুর বাজারে নেমে মোবাইল করলাম কর্ণজোড়া হাই স্কুলের শিক্ষক নওশাদ আলীকে। তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যে এসে হাজির হলেন। নওশাদের সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় মনে হয়েছিল যে, অনেক বয়স হবে তার। কিন্তু এখন দেখলাম খুব কম বয়স, ২৭ থেকে ২৮ এর মধ্যে। নওশাদ জানালেন, এই বাজারটি তাদের মালিকানাধীন। তাদের নিজেদের জায়গায় পুরো বাজার গড়ে উঠেছে। বাজারের সবগুলো পাকা দোকান ও কাঁচা পণ্যের দোকান থেকে তারা ভাড়া পান। বিনিময়ে সরকারকে তারা খাজনা দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের কোথাও আমি ব্যক্তি মালিকানাধীন হাট-বাজার দেখিনি। সেখানকার সব হাট-বাজারের মালিক ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ অথবা জেলা পরিষদ। কিছু কিছু হাট-বাজার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ কোন কোন প্রতিষ্ঠান চালিয়ে থাকে। ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক মালিকানার হাট-বাজার নাই। কিন্তু সমাসপুরে এসে জানলাম যে, পশ্চিম বাংলায় এ ধরণের হাট-বাজার অনেকের আছে। এখানে নওশাদদের অনেক দোকান। আবার তার ভাই জিয়াউর রহমান নিজেই একটি রেশন দোকান চালায় এই হাটে। তার সাথে পরিচয় হলো দোকানে। পরে নওশাদের আরেক ভাই আমজাদ আলী মটর সাইকেলে করে আমাকে বেলতোড় নামের একটি জায়গায় নিয়ে এলেন। এখানে তাদের দোতালা বাড়ি। বাড়ির নাম ‘নাজির হোসেন ফয়জুন নিহার ভবন।’ নওশাদের পিতা মৃত মোঃ নাজির হোসেন। মায়ের নাম ফয়জুন নিহার। পিতা-মাতার নামেই বাড়ির নাম।
দুপুরে আমার জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হলো। মুরগীর মাংস দিয়ে সাদা ভাত। ভারতে এসে প্রথম বারের মত মুরগী খেলাম। খাওয়া শেষে আলাপ হলো ফয়জুন নিহারের সাথে। বয়স হয়েছে যথেষ্ট। তিনি জানালেন যে, একরাম ছাড়াও বাংলাদেশে তাদের অনেক আত্বীয় রয়েছে।
আলাপকালে নওশাদ জানালেন, যদি কলকাতায় যেতে চাই তাহলে কালিয়াগঞ্জ থেকে ট্রেন ধরা ভাল হবে। এখানে ভীড় কম হবে এবং সীট পাওয়া যাবে। কিন্তু রায়গঞ্জে ভীড় বেশি। সেখানে সীট নাও পেতে পারি। নওশাদ আমাকে কালিয়াগঞ্জের একটি বাসে তুলে দিলেন বিকাল ৪টার দিকে। মাত্র আধা ঘন্টার পথ। বাস কালিয়াগঞ্জে গিয়ে রেল স্টেশনের কাছেই আমাকে নামিয়ে দিল। ষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে ১৪৫ টাকায় কলকাতার টিকিট কাটলাম। সীট পেতেও সমস্যা হলো না।

কালিয়াগঞ্জ টু কলকাতা :
ট্রেনযোগে কলকাতা যাত্রাটা খারাপ হয়নি। হেমতাবাদ থেকে কালিয়াগঞ্জে এসে পৌঁছাই ১৮ জুন ২০১৫ বিকাল সোয়া ৪ টায়। তখুনি কালিয়াগঞ্জ রেল ষ্টেশনে গিয়ে দেখি টিকেট কাউন্টার বন্ধ। খবর নিয়ে জানলাম বিকাল ৫টায় কাউন্টার খুলবে। এখানে আসামের গৌহাটি থেকে কলকাতার উেেদ্দশে ট্রেন আসবে সন্ধ্যা ৬টায়। সেই ট্রেন কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
ঠিক বিকাল ৫টায় কালিয়াগঞ্জ রেল স্টেশনের কাউন্টার হতে টিকেট বিক্রি শুরু হলো। লাইন ধরে কলকাতাগামী টিকিট নিলাম ১৪৫ টাকায় । যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮০ টাকা। ট্রেন এখান থেকে ছাড়ার পর কলকাতায় পৌঁছাবে সকাল ৬টায়। এত দূরের পথ কিন্তু এত কম ভাড়া ভেবে একটু অবাক না হয়ে পারিনি। বাংলাদেশে এরকম দূরত্বের পথ যেতে এর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়।
ভারতে ট্রেনের টাইমিংয়ের হেরফের নাই। যথাসময়ে ট্রেন আসা আর যথাসময়ে ছাড়া এটা এখানকার নিয়ম। তাই ভারতের অধিকাংশ মানুষ ট্রেনে চলাফেরা করেন। বাংলাদেশে এর উল্টো। নির্ধারিত সময়ের কত পরে ট্রেন আসবে আর কত পরে ছাড়বে তা জানা থাকে না কারো। তাই বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ট্রেনের চেয়ে বাসে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তাতে খরচ বেশি হয় বটে তবে সময় মত যাওয়া আসা করা যায়। অবশ্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রেলের উন্নয়নে প্রচুর কাজ করছে। মিটারগেজ রেলপথে ব্রডগেজ যুক্ত করছে। পুরাতন রেল সেতুর পাশে আধুনিক উন্নত সেতু করছে। গুরুত্বপুর্ণ রেল ষ্টেশনগুলোর সংস্কার করছে। তাই আশা করা যায় উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের ট্রেনেও টাইমিং থাকবে এবং অধিকাংশ মানুষ ট্রেনকেই প্রধান যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করবে।
সন্ধ্যা ৬টা ৩মিনিটে গৌহাটি হতে আসা ট্রেনটি কালিয়াগঞ্জ রেল স্টেশনে এসে থামে। অনেক লম্বা ট্রেন এটি। ট্রেনটিতে কয়েকশ যাত্রী উঠলেও নামলেন গুটি কয়েক। আমি আমার সীট খুঁজে নিয়ে বসে পড়লাম। সিঙ্গেল সীট। জানালার ধারে। দারুণ। ট্রেন আসার সাথে সাথে সীট দখল করার কারণ, বাংলাদেশে টিকিট থাকা সত্বেও সীট বেদখল হওয়ার উদাহরণ আছে। বেদখল হওয়া সীট পুনরুদ্ধার করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এখানেও যেন সে রকম কিছু না ঘটে সেটা ভেবেই আগে-ভাগে নিজ সীটে বসে যাত্রীদের আনাগোনা দেখতে থাকলাম ।
ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ছাড়ল। যতক্ষণ দিনের আলো ছিল ততক্ষণ জানালার বাইরে চোখ রেখে অফুরন্ত ভারত দেখতে লাগলাম। ট্রেন এগিয়ে গেল কলকাতার দিকে। আমি দেখতে থাকি ভারতের দিকে। কিন্তু বেশিক্ষণ না। ঘোর অন্ধকার নেমে আসে ঘন্টাখানেকের মধ্যে। বাইরের কিছু দেখা যায় না। এমন অবস্থায় চোখ ট্রেনের ভিতরে ফিরিয়ে আনি। ভিতর আলোকিত। পুরো বগি জুড়ে লোকে গীজ গীজ। অনেকের চোখ ধুলু ধুলু , ঘুম ঘুম ভাব। আমার মুখোমুখি সীটে সুদর্শন চেহারার একজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ফর্সা, লম্বা, ঘণ মোচ। পোশাকে, চেহারায় বনেদি ভাব। তার দিকে চোখ পড়তেই আমাকে জিঞ্জাসা করলেন; বাইরের দিকে তাকিয়ে এত কি দেখছিলেন?
ভদ্রলোকের প্রশ্নে হাসি পেয়ে গেল। আমি বাইরের দিকেই বেশিরভাগ সময় মনযোগি ছিলাম এটা তিনি মার্ক করেছেন! আমার প্রতি এত গভীর মনোযোগি মানুষ এর আগে কখনো পাইনি।
আমাদের ট্রেন পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ, বিহারের বারসই, আবারো পশ্চিমবঙ্গের কুমেদপুর, হরিশচন্দ্রপুর, মালদা, ওল্ড মালদা, ফারাক্কা, আজিমগঞ্জ হয়ে কলকাতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, সেই সাথে লোকটার সাথে আমার আলাপ জমে উঠে। তিনি জানালেন যে, তিনি কোলকাতা যাচ্ছেন, সেখানেই থাকেন এবং সরকারি চাকুরি করেন। তার নাম রেফাজুদ্দিন আহমেদ। আমার পরিচয়ও নিলেন তিনি। বললাম, আমিও কলকাতায় যাচ্ছি। কলকাতার কোন জায়গায় যাব তা এখনো জানি না। বাংলাদেশ থেকে এসেছি প্রথমবারের মত। বেড়াতে এসেছি। কতদিন ঘুরব জানি না। পরিস্থিতিই বলে দেবে কতদিন ঘুরব।
সব কিছু জেনে রেফাজুদ্দিন আহমেদ বেশ কিছু পরামর্শ দিলেন। তার মোবাইল নম্বর (৯৭৩৩৪৮৮৬৬৭) দিয়ে বললেন, প্রয়োজন মনে করলে ফোন দিবেন।
ট্রেনে রেফাজুদ্দিন আহমেদ বিস্কুট, কলা, ডিম, চিড়া ভাজা খেয়েছেন। আমাকেও খাইয়েছেন। যাত্রাপথে অপিরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে কোন কিছু খাওয়াটা ঝুঁকিপুর্ণ হলেও আমি খেয়েছি, তবে সতর্কতার সাথে। প্যাকেটযুক্ত বিস্কুট ও চিড়া ভাজা তার ব্যাগের ভেতরে ছিল। সেই প্যাকেট আমার সামনে খুলে সেখান থেকে বের করে খেয়েছেন এবং আমাকে দিয়েছেন। তিনি নিজে না খাওয়া পর্যন্ত আমি তা মুখে তুলিনি। আবার কলা ও ডিম কিনেছেন বাইরের হকারের কাছ থেকে। যখন কোথাও ট্রেন থেমেছে তখন তিনি তা কিনেছেন এবং আমাকেও দিয়েছেন। সেক্ষেত্রেও তিনি আগে মুখে না দেয়া পর্যন্ত আমি মুখে তুলিনি। সতর্কতা অবলম্বন করেছি, বলা তো যায় না কোথা থেকে কি হয় । ভদ্রবেশি চেহারার আড়ালে অনেক অন্ধকার থাকে সেটা আমার নিজের দেশে কম দেখিনি। অজ্ঞান পার্টি আর মলম পার্টির খবর মাঝে মাঝেই চোখে পড়েছে। কাজেই সতর্ক থাকা ভাল।
রেফাজুদ্দিন আহমেদ হলেন ভারতের প্রথম কোন ব্যক্তি যিনি আমাকে ৪ আইটেমের খাবার খাইয়েছেন। যখন তিনি খাবারগুলো আমাকে দিচ্ছিলেন, দেয়ার মধ্যে খুবই আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। আমি সেগুলো নিতে চাইনি। কিন্তু তিনি এমন ভাবে এ্যাপ্রোচ করেছেন যে, না বলতে পারিনি। বলা যায় অকৃত্রিম আতিথিয়তা ছিল তার মধ্যে। অথচ বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আতিথিয়তা সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক গল্প শুনি। তারা না কি খেতে দেয় না! অতিথি গেলে বিরক্ত হয়! তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে! ইত্যাদি। ইন্ডিয়ানদের আতিথিয়তা সম্পর্কে শোনা যায় যে, কোন মেহমান গেলে তারা সহজে কোন কিছু খেতে দেয় না। শুধু গল্প করতে থাকে। এক পর্যায়ে যখন তিনি চলে যেতে উদ্যোগ নেন, তখন তাকে বলা হয় যে, দাদা আজকে তো কিছু খেলেন না, এরপর এলে খাবেন কিন্তু!
অথচ এই ভারতীয় যিনি একজন মুসলিম এবং কোলকাতাবাসী, তার আন্তরিকতাপ্রিয় আতিথিয়তা আমাকে সেই সব প্রচলিত ধারনার বিপরীত ধারনা দিল। আমার মনে হলো, ভারতীয়দের, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মানুষের আতিথিয়তা সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রচলিত ধারনা পুরোপুরি সঠিক নয়। তাছাড়া আশিষ, তার ভাই, ভাই বউ পিংকির থেকে যে ধারণা পেয়েছি, তার থেকে আমার মনে হলো, বাংলাদেশে যেটা বলা হয় সেটা হয়ত কারো কারো বেলায় ঠিক, কিন্তু পশ্চিম বাংলার সব মানুষ তেমন নন।
বাংলাদেশে ট্রেনে উঠলে হিঁজড়াদের চাঁদাবাজি দেখা যায়। এটা আজকাল নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ ধরনের চাঁদাবাজি কলকাতাতেও দেখা যাবে এটা ধারনার বাইরে ছিল। মালদা (মালদার বিপরীতে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের অবস্থান) পার হওয়ার পর দেখলাম, একদল হিঁজড়া আমাদের বগিতে হিড়মিড় করে উঠছে। তারা ঐ বগির বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সব যাত্রীর কাছ থেকে চাঁদা তুলছে। তারা যাত্রীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রতিটি বাক্যের আগে একবার করে হাততালি দিচ্ছে। যারা ঘুমিয়ে ছিলেন সেইসব যাত্রীদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে হিজড়ারা ব্যাঙ্গ করে বলল, কিরে, এত ঘুমাচ্ছিস যে, টাকা দিবি না?
অনেকেই চাঁদা দিচ্ছে দেখলাম। কিন্ত একজন যাত্রী বিরক্তি নিয়ে বললেন, যা ভাগ, দিব না।
তার কথা শুনে উগ্রমুর্তি নিয়ে একজন হিঁজড়া দুই হাতের জোর তালি দিয়ে বলল, দিবি না? কেন দিবি না রে? দেখি তোর গালটা দেখি।
গাল নাড়তে নাড়তে হিজড়া বলে, তোর গালটা সুন্দর রে, খুব নরম রে, তুই টাকা না দিলে তোর গালে থাপ্পড় মারতে আরাম লাগবে রে!
এভাবে হিঁজড়ারা যাত্রীদেরকে বিরক্ত করে, সম্মানহানি করে, ভয় দেখিয়ে চাঁদা তুলতে থাকে। একজন হিঁজড়া রেফাজুদ্দিন আহমেদ এর কাছে এসে বলল, তুই কেন দিচ্ছিস না রে? রেফাজুদ্দিন বললেন, তোমরা টাকা নিবে নাও। ভদ্রভাবে কথা বল। এ রকম করছ কেন?
রেফাজুদ্দিন একটি ১০ টাকার নোট বের করে দিলেন। হিজড়াটা এরপর আমাকে বলল, দে তুই দে।
আমি পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই রেফাজুদ্দিন বললেন, উনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। উনার কাছ থেকে টাকা নিওনা।
হিজড়াটা রেফাজুদ্দিন এর এই কথাকে খুব গুরুত্ব দিলেন। আমার দিকে জোড়ে একটা হাততালি দিয়ে বললেন, তুই বাংগেলাদেশ থেকে এসেছিসরে? যা তোকে ছেড়ে দিলামরে।
আমাকে বাদ দিলেও মোটামুটি সকলের কাছ থেকেই হিজড়ারা যথেষ্ট দ্রæততার সাথে চাঁদা তুলে নিয়ে পরের রেলষ্টেশনে নেমে গেল। রেফাজুদ্দিন বললেন, সারা ভারতে হিজড়াদের এই দৌরাত্ব আছে। এ জন্য ট্রেন যাত্রীরা অতিষ্ট।
আমি তাকে বাংলাদেশের হিজড়াদের চাঁদাবাজির কথা তুলে ধরলাম। হিজড়াদের মাধ্যমে হিলি রেল স্টেশন এলাকায় চোরাচালান হয় সে কথা জানালাম। এভাবে গল্প করতে করতে মাঝরাতের দিকে ঘুম এসে গেল। যখন কোন স্টেশনে ট্রেন থামে, ঘুম ভেঙ্গে যায়। ট্রেন ছাড়লে আবার ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। এভাবে কলকাতায় যাওয়ার পথে আধো ঘুমের মধ্য দিয়ে রাত কাটে আমার।
ট্রেনে রেফাজুদ্দিন আহমেদ আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কলকাতার কোন জায়গায় নামব। তখন সেটা বলতে পারিনি, কোথায় নামব। তিনি জানিয়েছিলেন, কলকাতা অনেক বড় শহর এবং এই শহরের ভেতরে অনেক রেলস্টেশন আছে। তার কথায় বলেছিলাম, আগে কলকাতা স্টেশনেই নামব, তারপর ভাবব কোথায় যাব।

কোলকাতায় ১ম দিন :
১৮ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কালিয়াগঞ্জ হতে ছেড়ে আসা ট্রেনটি ১৯ জুন সকাল ৬টায় কলকাতা রেল স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। যাত্রীদের সবাই ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলেন। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ট্রেন কলকাতা চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। রেফাজুদ্দিন আহমেদ আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন; নামবেন না? কলকাতা চলে এসেছি তো।
হ্যান্ডশেক করে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লেন তিনি। গাড়ি থেকে নামার আগে বললেন; মোবাইল নম্বর তো থাকল, পারলে যোগাযোগ করে আসিয়েন।
যাত্রীরা ধীরে ধীরে নামছিলেন। আমিও নামলাম। কলকাতার বিশাল রেল স্টেশন দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানেই। তলপেটে চাপ আসায় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে টয়লেট কোথায়?। একজন দেখিয়ে দিলেন, এদিক দিয়ে ওদিকে যান।
টয়লেট সেরে, হাতমুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ টিকিট কাউন্টারের প্লাটফর্মে বসে থাকি আর ভাবি কি করব, কোথায় যাব। আমি প্লাটফর্মের একটি গোল পিলারের সাথে চতুর্দিকে তৈরী করা পাকা সেড এর উপর বসে ভাবছিলাম। কয়েক মিনিট বসতে না বসতেই একজন সুইপার এসে বললেন, বাবু য্যারা উঠিয়ে তো।
আমি তার কথায় উঠলাম আর তিনি ঐ পাকা সানটাকে পরিস্কার ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিলেন। মুছে দেয়ার পর সুইপার বলরেন, বাবু ব্যায়থিয়ে।
দেখলাম, কলকাতা রেল স্টেশন বেশ পরিস্কার। যারা এখানে পরিচ্ছন্নতার কাজে যুক্ত তাদের ব্যবহারও ভাল। আমাকে উঠে যেতে বললেও সুইপারের মধ্যে বিনয়ী ভাব ছিল। বসতে বলার সময়ও যথেষ্ট বিনয়ের সাথে তা বলেছেন। বিদেশ-বিভুঁয়ে এসে মানুষের আচরণ, ব্যবহার যখন পজেটিভ পাওয়া যায় তখন মনে হয় গোটা পৃথিবীই সুন্দর। নিজের দেশকে যেমন ভাল লাগে, নিজের স্ত্রী, সন্তান,আত্মীয় আর প্রতিবেশিদেরকে যখন কাছের মানুষ, ভাল মানুষ বলে মনে হয়, তখন ভিন দেশের এই মানুষগুলোকেও ভাল মানুষ ভাবতে ভাল লাগে। কারণ এই মানুষেরা মানুষকে সন্মান দিয়ে, মর্যাদা দিয়ে কথা বলেন।
আমি আরো কয়েক মিনিট বসে থাকার সময় একজন মধ্য বয়সী লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন এবং আমার পেছনে থাকা একটা টোপলা কুড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ^াস ফেললেন। খুশি খুশি ভাব মুখে বললেন যে, তিনি হাওড়া স্টেশন থেকে এটার জন্য ছুটে এসেছেন! এখানে তার ছোট বাচ্চার কাপড় আছে। ভুল করে সকাল বেলা ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।
লোকটির কথায় অবাক হলাম। কারন টোপলাটিকে আমি শুরু থেকে দেখতে পেলেও মনে করিনি যে, কেউ ভুল করে এটা ফেলে গেছে। আমার ধারনা হয়েছিল হয়তো কেউ রেখে গেছে, মালিক আশে-পাশে আছে। কিন্তু যে টোপলা এতক্ষণ পড়ে থাকল, সেটাতে কেউই ছুঁলোনা অবাক হলাম সেই কথা ভেবে!
কলকাতা রেল স্টেশনে পৌনে এক ঘন্টার মত থাকলাম। এর মধ্যে ছবি তুললাম গোটা কয়েক। সবগুলোই সেলফি। এরপর স্টেশন এলাকা থেকে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে যে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম, সেই রাস্তার ধারে একটি হোটেল থেকে নাস্তা খেয়ে নিলাম। এরপর ভাবলাম সল্টলেকে যাই। সেখানে দিনাজপুর জেলা শহরের এক সময়ের অধিবাসী, বর্তমানে কলকাতার অধিবাসী ও পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব শ্যামল সেন গুপ্ত থাকেন। যদি তার সাথে দেখা হয় তাহলে তার পরামর্শ নিয়ে কোন একটা হোটেলে উঠব। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম; সল্টলেকে কিভাবে যাব?
দু-তিনজন প্রায় সমস্বরে বললেন; সল্টলেকে যাবেন? ঐ পাশে যান, সেখানে করুনাময়ীর গাড়ি পাবেন। ঐ গাড়িতে করুনাময়ী গেলে সল্টলেক পেয়ে যাবেন।
উঠলাম গাড়িতে। গাড়ি এগিয়ে চলল করুনাময়ীর দিকে। ৩০-৩৫ মিনিট পর যেখানে নামিয়ে দিল সেটা করুনাময়ী আর সেখান থেকে বাম দিক ধরে একটি পাকা রাস্তা শুরু হয়েছে যার নাম সল্টলেক। আমি সেই রাস্তা ধরে কিছুদুর হেঁটে গেলাম। অভিজাত এলাকা, এটা বোঝা গেল এর চারদিকের বিশাল-সুউচ্চ ভবন ও চমৎকার পরিবেশ দেখে। ঢাকার ধানমন্ডি, বনানী যেমন এই সল্টলেক সেরকমই। বেশ কিছুটা হেঁটে এগিয়ে যাওয়ার পর একখানে দাঁড়িয়ে মোবাইল দিলাম শ্যামল সেনকে। তিনি ফোন রিসিভ করলেন। আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম যে, আমি কলকাতায় এসেছি এবং এই মুহুর্তে সল্টলেকে আছি। আপনার সাথে দেখা করতে চাই।

কোলকাতায় আকাশবাণী ভবন

কিন্তু বিধি বাম। যার জন্য এখানে আসা তিনি জানালেন, তিনি এখন সল্টলেকে থাকেন না। তবে আমি যেখানেই উঠি না কেন, যদি তাকে জানাই তাহলে তিনি আমার সাথে দেখা করবেন।
সল্টলেকে থাকেন না জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারন সল্টলেকে তাকে টার্গেট করেই আসা। কলকাতার মধ্যে একমাত্র তিনিই আমার জানা- শোনা ব্যক্তি যার সাথে বাংলাদেশের দিনাজপুরে পরিচয় ও আলাপ হয়েছিল। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি লেখালেখি করি এবং সেই ইস্যুতে তার একটি সাক্ষাতকার নিয়েছি। সেই সাক্ষাতকার আমার লেখা “ইয়াসমিন আন্দোলন সংখ্যালঘু নির্যাতন আরো কিছু কথা” বইয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবে ছাপিয়েছি। তার হাতে সেই বইয়ের একটি কপি তুলে দেয়া, কিছু পরামর্শ নেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারনে তার সাথে দেখা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু হলো না!
সল্টলেকে একটি আবাসিক হোটেল পেলাম যার নামের শেষে গার্ডেন শব্দটি ছিল। সেখানে গিয়ে সিঙ্গেল রুমের ভাড়া কত জানতে চাইলাম। একজন জানালেন ১৯০০ টাকা। তার কাছে জানতে চাইলাম, কম ভাড়ার আবাসিক হোটেল কোথায় পাব? তিনি জানালেন যে, যদি শিয়ালদহ যাই তাহলে সেখানে কম ভাড়ার অনেক হোটেল পাব যা সল্টলেকে পাওয়া যাবে না। করুনাময়ী থেকেই শিয়ালদহের গাড়ি পাওয়া যাবে, এ কথাও জানালেন তিনি।
উঠলাম শিয়ালদহের বাসে। বাস ভাড়া ৯টাকা। কলকাতা শহরে বাসে উঠলেই ৯টাকা। যেখানে উঠেন আর যেখানে যান ভাড়া ৯টাকা। সস্তা ভাড়া। ৯ টাকায় বহুদুর যাওয়া যায়। ঢাকায় এত দূর রাস্তা যেতে হরৈ ৪০-৫০ টাকার কমে হবে না।
শিয়ালদহ এসে হোটেল পাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলা হলো। আবাসিক যে হোটেলেই যাই, হোটেলের লোকেরা বলেন যে, বাংলাদেশি রাখা যাবে না! এমন কথায় আমি অবাক!
আমি হোটেলগুলোয় গিয়ে প্রথমে জানতে চাই, সিঙ্গেল সীট আছে কি না?
সব হোটেলেই উত্তর পেয়েছি, আছে। ভাড়া ২০০ হতে ৩০০ টাকার মধ্যে।। আমি রুম দেখতে চাইলে হোটেলের লোকেরা রুম দেখায়। পছন্দ হয়েছে জানালে তারা আধার কার্ড (জাতীয় পরিচয় পত্র ) চায়। আমি বলি, আধার কার্ড নাই, পাসপোর্ট আছে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
যখুনি বলেছি,বাংলাদেশ থেকে এসেছি, হোটেলের লোকেরা কেমন যেন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! বলেছে, না না, আমরা বাংলাদেশি রাখি না! পুলিশের নিষেধ আছে!
এভাবে ১০-১২টি আবাসিক হোটেল ঘুরে ঘুরে হতাশ আমি। বাংলাদেশিদের জন্য সব হোটেল নিষেধ না কি! পুলিশের নিষেধের কথা কলকাতা, শিলিগুড়িতে শুনিনি। সেখানকার যে হোটেলেই গিয়েছি, পরিচয় দিয়েছি যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সবাই বলেছেন, কোন সমস্যা নেই। হোটেলের লোকেরা শুধু জানতে চেয়েছেন, আমার পাসপোর্ট এবং ভিসা আছে কি না। পাসপোর্ট আছে জানার পর আর কোন প্রশ্ন করেননি। কিন্তু কলকাতায় এসে ভয়াবহ বিপদেই পড়লাম বলে মনে হলো। হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে একটি হোটেলের ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলাম; এখানে বাংলাদেশিদের থাকার কোন হোটেল কি নাই?
তিনি দুইটি হোটেলের নাম বললেন। এর মধ্যে একটির নাম ‘হোটেল শ্রী দূর্গা।’ কয়েক মিনিট পরে খুঁজে পেলাম সেটা। সেই হোটেলের সাইনবোর্ডে “এখানে বাংলাদেশি রাখা হয়” এমন কথাও লেখা আছে দেখলাম। দেখে মন খুশিতে ভরে গেল। টাকা যাই লাগুক, রাত কাটানোর দুঃশ্চিন্তা অন্তত থাকছে না।
এখানে কোন সিঙ্গেল রুম নাই। সবই ডবল, জানালেন হোটেল শ্রী দূর্গার ম্যানেজার। দুজন থাকলে ভাড়া ৮শ’ টাকা। তবে আমি যেহেতু একা থাকব, আমাকে দিতে হবে সাড়ে ৫শ’ টাকা। এটা কমিয়ে ৫শ’ করতে চাইলাম। ম্যানেজার রাজি হলেন না। অগত্য সাড়ে ৫শ’ টাকাতেই রাজি আমি।
আমার রুম নম্বর ৬২। হোটেলটির ৪ তলায় এই রুম। ভবনটি সম্ভবত বৃটিশ আমলের। সিঁড়ির বড় বড় ধাপ পেরিয়ে ৪ তলা পর্যন্ত উঠতে হাঁফসে যেতে হয়। ভবন পুরনো হলেও রুমটি টাইলস দিয়ে মোড়ানো। বেশ বড় এবং পরিচ্ছন্ন। পায়খানা সেরে, গোসল করে কিছুক্ষণ টিভি দেখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার্ক দেখতে বের হলাম। সল্টলেকের পাশে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার্ক এটা সকালে জানা ছিল না। জানা থাকলে হয়ত তখুনি দেখে নেয়া যেত। এর আশে-পাশে আছে ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, বিবেকানন্দ উদ্যোন, ইন্দিরা উদ্যোন সহ আরো কিছু পার্ক, ষ্ট্রীট, ভাস্কর্য। ঘুরে ঘুরে সেগুলো দেখে নিলাম ঘন্টখানেক সময় ধরে।
মোটামুটি ঘোরা শেষ হলে বিবেকানন্দ উদ্যোনের কাছে একটি বাসে উঠে বললাম, ধর্মতলা যাব। কিন্তু বাস কন্ডাক্টর জানালেন, এই বাস ধর্মতলা থেকেই আসছে। এটা এখন গড়িয়া যাবে। ধর্মতলা কিংবা গড়িয়া কোনটাই আমার চেনা নয়। দেখার জন্য যে কোন একখানে গেলেই হলো। আমি বললাম, ঠিক আছে, গড়িয়াতেই যাব। বাসটি হাজরা রোড, শ্যামা প্রসাদ মূখার্জী রোড, টালিগঞ্জ, নেতাজী নগর, এনএসসি বোস রোড, নাকতলা হয়ে গড়িয়া যখন পৌঁছাল, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। আমি গড়িয়া মোড়ে কিছুক্ষণ আড্ডাবাজি করে, চা খেয়ে, এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। এরপর লোকের কাছে জানতে চাইলাম এখান থেকে শিয়ালদহ রেল স্টেশন কিভাবে যাব? শিয়ালদহ রেল স্টেশনের কথা বলার কারন, আমি যে হোটেলে উঠেছি সেটা শিয়ালদহ রেল স্টেশন এর কাছে। লোকে আমাকে বুদ্ধি দিল, অল্প কিছুটা হেঁটে গেলে গড়িয়া রেল স্টেশন পাবেন। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে ৫টাকায় শিয়ালদহ রেল স্টেশন যেতে পারবেন।
সন্ধ্যার কিছু আগে যখন আমি বাসে ছিলাম সেই সময় কলকাতায় হালকা বৃষ্টি হয়েছে। এ কারনে রাস্তাঘাট ভেজা ও কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও ধীরে ধীরে ভেজা রাস্তা ধরে হেঁটে পৌঁছে গেলাম গড়িয়া রেল স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে শিয়ালদহ ফিরে এলাম রাত ৯টার দিকে। এরপর খাওয়া সেরে সূর্যসেন ষ্ট্রিট ধরে শ্রী দূর্গা হোটেলে পৌঁছে গেলাম।

চিটিংবাজির শিকার :
০৩-০৬-১৫ : কলকাতার শিয়ালদহে সূর্যসেন ষ্ট্রীটের ৬২নং হোটেল শ্রী দুর্গায় প্রথম রাত কাটিয়ে খুব সকালে ঘুম ভাংলেও শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর সকাল ৮টায় উঠে হাত, মুখ ধুয়ে ৯টার দিকে বাসে চেপে হাওড়া যাই। হাওড়া রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে গেছে গঙ্গা নদী। এই নদীর উপর রয়েছে বিশ^ বিখ্যাত হাওড়া সেতু। ঝুলন্ত সেতু এটা। এতবড় সেতু কোন পিলার ছাড়াই বিশাল গঙ্গার উপর কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা ভেবে আমি বিস্মিত। নান্দনিক হাওড়া সেতু দর্শনে আমি দারুনভাবে বিমোহিত। সেতু হেঁটে পারাপার হলাম দু’বার। বেশ কিছু ছবি তুললাম। ছবি যখন তুলছি, সেই সময় একজন লোক আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বললেন; দাদা, ক্যামেরাটা পকেটে ঢুকিয়ে নিন। পুলিশ দেখলে কেড়ে নেবে!

কোলকাতা ষ্টেডিয়ামের পাশেই বিপদ

লোকটির কথায় অবাক হলাম! কেন? ক্যামেরা কেড়ে নেবে কেন? ছবি তোলা নিষেধ না কি? হতচকিত হয়ে সেতুর উপর দিকে চোখ মেলতেই দেখলাম, ছোট ছোট স্টিল বোর্ডে ইংরেজীতে লেখা রয়েছে, ফটো তোলা ষ্টিকলি নিষেধ।
আমি সাধারণ ভাবে কিছু নীতিমালা মেনে চলি। এর মধ্যে অন্যতম হলো, কোথাও নিষেধাজ্ঞা কিংবা নিষিদ্ধ থাকলে তা মেনে চলা। এখানে ছবি তোলা নিষেধ লেখা বোর্ড এতক্ষণ খেয়াল করিনি। এখন দেখার পর ক্যামেরা পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম।
হাওড়া ব্রীজ ও হাওড়া রেল স্টেশনের অবস্থান পাশাপাশি। ষ্টেশন থেকে হাজার হাজার মানুষ বের হচ্ছে, আবার হাজার হাজার মানুষ ঢুকছে। কোন কোন স্থানে পিপিলিকা কিংবা সাপের বাচ্চা যেমন কিলবিল করতে দেখা যায়, এই ষ্টেশনে তেমনি মানুষকে দেখা গেল কিলবিল করে বের হতে আর ঢুকতে।
হাওড়া সেতুর পরিবর্তে আমি রেলস্টেশনের ভেতরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বেশ কিছু ছবি তুললাম। এরপর ষ্টেশন সংলগ্ন গঙ্গাঘাটে ৫ টাকা টিকিট কেটে লঞ্চযোগে নদী পার হলাম। নদীর যে ঘাটে লঞ্চ থামল সেই ঘাটের পাশে একটি বিনোদন পার্ক আছে। নাম মিলেনিাম পার্ক। সেই পার্কে কিছুক্ষন ঘুরপাক করলাম। ঘন্টাখানেক পর পার্ক থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে কলকাতার বহু সংখ্যক পুরাতন ভবন দেখতে থাকলাম। আমার মনে হলো দিনাজপুরের সোনালী ব্যাংক, সার্কিট হাউস এরকম পুরাতন ও বৈচিত্রময় ভবন ছিল। কিন্তু সেগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অথচ কলকাতার পুরাতন ভবনগুলো সংরক্ষণ করে সরকারি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে ভবনগুলো যেমন কাজে লাগছে তেমনি ঐতিহ্যও রক্ষা হচ্ছে।
পুরনো ও নতুন ভবন দেখতে দেখতে বিভিন্ন পথ, এভিনিউ ঘুরে আকাশবাণী ভবন হয়ে কলকাতা ষ্টেডিয়ামের দিকে আসতেই বিপদে পড়লাম। ষ্টেডিয়াম এবং এর আশে-পাশের বেশ কিছু ছবি তোলার পর যখন স্টেডিয়াম এলাকা অতিক্রম করছি, সেই সময় কলকাতা পুলিশের একটি গাড়ি থেকে আমাকে লক্ষ্য করে একজন পুলিশ অফিসার ডাকলেন; দাদা, শুনুন।
পুলিশের গাড়িটি রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে ছিল। এর পাশ দিয়েই আমি যাচ্ছিলাম। আর তখুনি গাড়ির ভিতর থেকে সেই ডাক পেলাম; দাদা, শুনুন।
আমি তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্ক পুলিশ অফিসার গাড়ির জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নমস্কার বলে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি আমার ক্যামেরা দেখিয়ে বললেন, দাদাকে দেখছি অনেক ছবি তুলছেন। বাড়ি কোথায় আপনার?
লোকটির কথায় বিনয়ী ভাব। আমিও খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম, দিনাজপুরে। : দিনাজপুরে? দিনাজপুরের কোন জায়গায়?
বললাম, বাংলাদেশের দিনাজপুরে।
আমার উত্তর পেয়ে তখুনি তিনি যেন আঁটকে উঠলেন। বললেন, বাংলাদেশে? আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। উঠুনতো দাদা, একটু গাড়িতে উঠুন। আপনার সাথে কথা বলি।
ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমি উঠে বসলাম। গাড়িতে উঠার পর গাড়ি ধীর গতিতে চলতে থাকে। চলতে চলতে পুলিশ অফিসার বললেন, দেখি আপনার ক্যামেরাটা। আমি তাকে ক্যামেরা দিলাম। কিন্তু তিনি ক্যামেরা ওপেন করলেন না। নিজের কাছে রেখে দিয়ে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ থেকে কবে এসেছেন?
হিলি দিয়ে ইন্ডিয়া ঢুকেছি ১৩ তারিখে। কলকাতায় এসেছি গতকাল।- বললাম আমি।
কলকাতায় আসার আগে কোথায় ছিলেন?
রায়গঞ্জে, শিলিগুঁড়িতে।
পাসপোর্ট আছে?
পাসপোর্ট হোটেলে আছে, ফটোকপি নিয়ে এসেছি।-ফটোকপি দেখালাম।
কিন্তু ফটোকপি দেখেই পুলিশ অফিসার আবারো আঁটকে উঠার মত করে মন্তব্য করলেন, ই মা, পাসপোর্টের যা অবস্থা!
তার কথার সাথে সুর মিলিয়ে ড্রাইভার বলল; পাসপোর্ট মনে হচ্ছে গলাকাটা স্যার। আজ গলাকাটা পাসপোর্টে আসা ছয়জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছে।
আমি বললাম; না না, গলাকাটা হবে কেন? হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে পাসপোর্ট হোটেলে রেখে ফটোকপি নিয়ে বেড়াচ্ছি। যে হোটেলে উঠেছি সেখানে চলেন, পাসপোর্ট দেখিয়ে দিচ্ছি।
আমি হোটেল শ্রীদূর্গার নাম বললাম। কিন্তু পুলিশ অফিসার আমার কথার গুরুত্ব দিলেন না। তিনি হোটেলে গেলেন না। ক্যামেরা দেখলেন না। ড্রাইভারকে বললেন, ওনার পাসপোর্ট তো নাই। চল থানায় যাই, উনি সেখানে গিয়ে যা বলার বলবেন।
আমি আবারো বলি, পাসপোর্ট নাই বলছেন কেন? হোটেলে আছে গেলেই দেখাতে পারব। দরকার হলে আপনি হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলুন।
আমি হোটেল শ্রীদূর্গার টেলিফোন নম্বর দিলাম। কিন্তু হোটেলে যাওয়ার ব্যাপারে, টেলিফোনে কথা বলার ব্যাপারে, কোন কিছুতেই তিনি আগ্রহ দেখালেন না। ড্রাইভারকে বললেন, তুমি থানায় যাও সেখানে উনি যা বলার বলবেন।
ড্রাইভার তার কথায় জি স্যার বলেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। গাড়ি এদিক ওদিক সামান্য ঘুরে। এর মধ্যেই অফিসার বলেন; পাসপোর্ট ছাড়া ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। থানায় নিয়ে গেলে নির্ঘাত ছয় মাসের জেল হবে। কি করবেন, তাড়াতাড়ি বলেন।
অফিসারের কথায় বিস্মিত হলাম। তিনি স্পষ্টই ঘুষের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বুঝতে পারলাম, পাসপোর্ট ও ক্যামেরার ব্যাপারটা নিয়ে দু’কথা বললেও তাতে মনযোগ নাই। তার মনযোগ অন্যদিকে। তিনি বললেন, আপনাকে দেখে ভাল মানুষ মনে হচ্ছে। এখন কি করবেন বলেন।
বললাম, কি করব আপনিই বলেন?
পুলিশ অফিসার পরিস্কার করে বললেন, ৬ হাজার টাকা দেন। টাকা দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যান।
আমার বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা সব আছে। তারপরেও কলকাতা পুলিশের এই আচরণ অচিন্তনীয় মনে হলো। কিন্তু যেহেতু তিনি টাকার ধান্ধা করছেন, আমি ভাবলাম যদি কিছু না দেই তাহলে হয়ত ঝামেলা পাকাতে পারেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন। বিপদে ফেলতে পারেন।
অফিসার ৬ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। তার আগে জেনে নিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ থেকে আসার সময় আমি কত টাকা এনেছি। আমি জানাই যে, ১২হাজার টাকা এনেছি। এখন বুঝতে পারলাম তার এই তথ্য জানার মাজেজা। অর্থাৎ আমি যত টাকা এনেছি তার অর্ধেক তিনি বেকায়দায় ফেলে নিয়ে নিতে চাইছেন।
যেন কোন ঝামেলায় না পড়ি, সেজন্য আমি ৫শ টাকা অফার করলাম। কিন্তু তিনি ড্রাইভারকে বললেন, তুমি থানায় যাও, যা হবার সেখানেই হবে।
শেষ পর্যন্ত ২ হাজার টাকা দিয়ে আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় হলাম। ঁঢ়ংবঃ অবস্থায় ফিরে এলাম হোটেলে। মন খারাপ বলে বাইরে আর বের হলাম না। তবে মন ভাল করার জন্য বিকালে জগত সিনেমা হলে জেন্ডারস সেক্স লাভার এন্ড মার্ডার বইটি দেখলাম। রাতে শ্যামল সেন হোটেলে এসে আমার সাথে দেখা করলেন। তার সাথে কিছু কথা হলো। ইয়াসমিন আন্দোলন বইটির ২কপি ও বহলা গণহত্যা বইটির ১কপি দিলাম।

কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসে মালদা :
২১-৬-১৫ : কলকাতা পুলিশ আমার সাথে এক ধরনের চিটিংবাজি করেছে। ইন্ডিয়ান মুদ্রায় দুই হাজার রুপী যা বাংলাদেশি আড়াই হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কারণে আমার মন ভীষন খারাপ। এ ঘটনায় সিদ্ধান্ত নিলাম ইন্ডিয়ায় আর থাকবনা।
গতকাল রাতেই ট্রেনের সময়সূচি জেনে নিয়েছি। সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে শিয়ালদহ রেল স্টেশন হতে একটি ট্রেন আসামের গৌহাটির উদ্দেশে রওনা দেবে। ট্রেনটির রুট হলো মালদা হয়ে গৌহাটি। কলকাতা হতে হিলি যেতে হলে আমাকে অবশ্যই মালদা দিয়ে যেতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এই ট্রেনেই রওনা দেব। ট্রেনের নাম কাঞ্চনজঙ্গা।
হোটেল কাউন্টারে বলে রেখেছিলাম ভোর সাড়ে ৫ টার মধ্যে ষ্টেশনে যাব। আমাকে যেন তার আগেই ডেকে দেয়। কিন্তু অস্থিরতায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল রাত ৩টায়। এরপর আর ঘুম হলো না।
কাপড়-চোপড় গোছানো ছিল। হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নিলাম। ভোর ৫টার দিকে আমার রুমের টেলিফোন বাজল। বুঝলাম হোটেলের গেটকিপার ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে জানালাম যে, আমি উঠেছি। ভোর সাড়ে ৫টার আগেই রুম থেকে বের হলাম। ততক্ষনে দিনের আলো স্পষ্ট হয়েছে। সবকিছু দেখা যাচ্ছে।
শ্রী দূর্গা হোটেল থেকে শিয়ালদহ ষ্টেশন পায়ে হাঁটা পথ। আমি হেঁটেই ষ্টেশনে গেলাম। লাইন ধরে কাঞ্চন জঙ্গা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটলাম। এটাই মালদা হয়ে গোহাটি যাবে।
গাড়ী ছাড়বে ৩নং প্লাটফর্ম থেকে। এই স্টেশনে অসংখ্য প্লাটফর্ম। কোন গাড়ি কোন প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে বোঝা মুশকিল। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে প্লাটফর্ম চিনে নিলাম। সেখানে এসে দেখলাম, ট্রেন তখনো ভিড়েনি। কিন্তু ট্রেনে ওঠার জন্য শত শত যাত্রী লাইন ধরেছে। সবাই অর্ডিনারী টিকেটের যাত্রী। আমার টিকিটও অর্ডিনারী। ভাড়া নিয়েছে ১১৫ টাকা।
৩নং প্লাটফর্মে এসে দেখি বিরাট লাইন। লাইনের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম; এটা কিসের লাইন? তিনি জানালেন; কাঞ্চন জঙ্গা এক্সপ্রেসের যাত্রীদের লাইন। লাইন ধরে উঠে সিট নিতে হবে।
: লাইন ধরে উঠতে হবে?
: এখানে সবকিছুতেই লাইন, বললেন লাইনে থাকা অন্য একজন।
আমি তখন লাইনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। বিশাল লাইন। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঞ্চন জঙ্গা এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালে লাইন একটু একটু করে এগুতে থাকল। কিন্তু তাতে আমার লাভ হলো না। সিট পেলাম না। ট্রেনের একটি বগিতে ভিড় ঠেলাঠেলি করে কোন রকমে উঠলাম মাত্র। দাঁড়িয়ে থাকলাম একটি সিঙ্গেল সিটের পাশে। এই সিঙ্গেল সিটে শিলিগুঁড়ির একজন যাত্রী ছিলেন। তিনি তার সিটে মাঝে মাঝে আমাকে, মাঝে মাঝে অন্যকে বসতে দিয়ে সহযোগিতা করলেন। প্রবল ভিড়ের মধ্যে তার এই সহযোগিতা মনে রাখার মত।
কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসের যাওয়ার কথা বর্ধমান দিয়ে। কিন্তু গাড়ী ছাড়ার আগে শিয়ালদাহ ষ্টেশনে মাইক থেকে বার বার ঘোষনা আসছিল যে, ট্রেনটি ট্রাফিক জ্যাম জনিত কারনে নির্ধারিত রুটের পরিবর্তে নৈবেদ্য বান্ডেল হয়ে যাবে। এটা ঘুরপথ। এই রুট দিয়ে ট্রেনটি আসার কারনে নির্ধারিত সময় দুপুর ২টার পরিবর্তে বিকাল প্রায় ৪টার দিকে গাড়ি মালদা এসে পৌঁছাল। আমি মালদায় নেমে একটি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাস ষ্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম যেখান থেকে বালুরঘাট যাওয়া যাবে, সেদিকে। কারন আমার ইচ্ছে যেন আজকেই বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারি।
পথের একটি হোটেলে বসে কিছু খেয়ে নিলাম। তারপর মালদা বাসষ্ঠ্যান্ডে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বালুরঘাটের বাস পেলাম। ৪৫ টাকা ভাড়া। বাস বুনিয়াদপুর-গংগারামপুর হয়ে বালুরঘাট আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সেখান থেকে আরেকটি বাস ধরে হিলি। ভাড়া ২০ টাকা। এই বাস এত ধীর গতিতে এলো যে, হিলি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় সাড়ে ৮টা পার হয়ে গেল। আমি গেলাম ভারতীয় হিলি কাষ্টমস এর দিকে। সেখানে গিয়ে বিএসএফ এর কিছু সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকা দেখলাম, কিন্তু কাষ্টমস এর সমস্ত অফিস বন্ধ। এর অর্থ বাংলাদেশে ঢোকার কোন সুযোগ আজ আর নাই।
আমি লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে আবাসিক হোটেল কোথায় আছে? লোকজন জানালেন যে, পাশেই হিলি ১ নং পঞ্চায়েত এর কার্যালয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে।
আমি গেলাম সেই কার্যালয়ে। দেড়শ টাকা রুম ভাড়ায় সেখানে উঠলাম। যখন সেখানে গেলাম তখন দেখি, কয়েকজন যুবক টিভির সামনে ক্রিকেট খেলা দেখছেন। খেলা চলছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের। আমিও সেখানে বসে খেলা দেখা শুরু করলাম। সেই খেলায় বাংলাদেশ তার প্রতিপক্ষ ভারতকে হারিয়েছিল। তখন এক যুবক মুচকি হেসে আমাকে বলেন, তোমরা (বাংলাদেশ) যেন সামনের বিশ^কাপে খেলতে পারো, সেজন্যেই আমরা (ইন্ডিয়া) আজ হারলাম। না হলে তোমাদের কাছে আমাদের হারার কোন কারণ ছিল না। তোমরা আমাদের ছোট ভাই। তাই এটুকু করলাম।
তার কথায় হাসলাম আমিও। বুঝলাম এই হার তাকে ভাল লাগেনি, তার বুকে জ¦ালা ধরিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্কে গেলাম না। কেন না সেখানে তো আমি একা। বাংলাদেশ জিতে যাওয়ায় আমার মধ্যে একটা সুখানুভুতি অনুভব করলাম। কিন্তু ঘুমাতে গিয়ে সুখ আর থাকল না মশা ও পোকার কামড়ে। মশারী ছিল না। মশা আর পোকায় রাতে ভাল ঘুম হলো না।

অত:পর ফিরে আসা :
২২-৬-১৫ : সকালে উঠে ইন্ডিয়ার হিলি বাজারে নাস্তা খেয়ে নিলাম। এরপর ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে গেলাম হিলি কাষ্টমসে। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ, দ’ুদেশের কাষ্টমস অফিসে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে যখন বাস ধরার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি, তখনি একজন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, মাইক্রো নিবেন স্যার?
: না, বাসে যাব।
: স্যার বাস ভাড়া যেটা দিবেন, সেটাই আমাকে দিয়েন।
অত:পর আমি মাইক্রোয় উঠলাম সেই লোক আরো দু-একজন ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পেলেন না কাউকেই। তিনি মাইক্রো স্টার্ট দিলেন। আমিই একমাত্র যাত্রী। দুপুর ১২টার দিকে ড্রাইভার আমাকে বাড়ির দুয়ারে এসে নামিয়ে দিলেন। তাকে বাস ভাড়ার ১০০ টাকার সাথে আরো ১০০ টাকা বেশি দিয়ে মোট ২০০ টাকায় বিদায় দিলাম। বললেন, ভাড়া নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে তো আসতে হতোই। এই টাকাটা আমার তেল খরচের কিছুটা যোগান দিল।
আজহারুল আজাদ জুয়েল
সাংবাদিক, কলামিষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।