একরামুল হক মুন্না: পঞ্চগড় প্রতিনিধি:
সেই স্বপ্ন পূরণে পথে পঞ্চগড়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই ভাই। মানুষের কটুক্তিসহ নানা বাধা। কোনোকিছুই তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। শিক্ষার প্রতিটি ধাপে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তারা।দুই ভাইয়ের একজন সেলিম ইসলাম অনিক, অন্যজন রাইসুল ইসলাম আসাদ। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় দরিদ্র পরিবারের এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই ভাই পেয়েছেন জিপিএ-৫। এখন তাদের স্বপ্ন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। ছোট ভাই রাইসুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার মেধাক্রম ৫৪০। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার পেছনে এখন বড় বাধা তাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতা।পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর এলাকার দরিদ্র রং মিস্ত্রী শহিদুল ইসলামের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সেলিম ইসলাম অনিক আর মেঝ ছেলে রাইসুল ইসলাম আসাদ। সেলিম আট বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হয়ে যান। ভালো চোখ নিয়ে ঘুমালেও সকালে উঠে আবিষ্কার করেন তিনি আর চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। এর ঠিক দেড় থেকে দুই বছর পর একইভাবে অন্ধ হয়ে যান তার ছোট ভাই রাইসুলও।দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই ভাইকে নিয়ে দরিদ্র বাবা বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করালেও চিকিৎসকরা জানান তাদের এই চোখ আর ভালো হবে না। এরপর থেকে বাড়িতেই বসে ছিলেন দুই ভাই। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে বললেও তাতে রাজি হননি অভিভাবকরা।একদিন স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষকের মাধ্যমে শহিদুল ইসলাম জানতে পারেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পঞ্চগড়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়ার সুযোগ রয়েছে। ২০০৬ সালে তিনি তার দুই ছেলেকে পঞ্চগড় সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যালয়ে নিয়ে যান। ভর্তির পর সেখান থেকে দুই সহোদয় সামনে এগিয়ে চলেছেন।২০১৬ সালে পঞ্চগড়ের কমলাপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেন দুই ভাই। এরপর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায়। খুব কষ্ট করে ঢাকা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তারা। রাইসুল পেয়েছেন গোল্ডেন জিপিএ-৫ আর সেলিম পেয়েছেন সাধারণ জিপিএ-৫। তাদের ভালো ফলে পরিবারের পাশাপাশি খুশি স্থানীয়রাও।অন্ধত্বের গ্লানি, সামাজিক অবজ্ঞা কোনো প্রতিকূলতাই আটকাতে পাড়েনি দুই অদম্যকে। এখন তাদের স্বপ্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। এরই মধ্যে ছোট ভাই রাইসুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বড় ভাই সেলিম একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এই উচ্চ শিক্ষার পথে এখন বড় বাধা তাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতা।একসঙ্গে চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করাতে হাঁপিয়ে উঠেছেন তাদের বাবা শহিদুল ইসলাম। সম্পদ বলতে ভিটেবাড়ির ছয় শতক জমি। বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেলেও তা যথেষ্ট নয়। সরকারি সহযোগিতা আর উৎসাহ পেলে অন্ধ চোখ নিয়েও আলোর পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারেন তাঁর এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই সন্তান।শহিদুল ইসলামের পাঁচ সন্তানের সবার বড় শাহিদা আক্তার। তাকে বিয়ে দিয়েছেন। তারও এক চোখ টাইফয়েডে নষ্ট। তার ছোট সেলিম আর মেঝ রাইসুল; রাইসুলের ছোট সিমলা আক্তার অষ্টম শ্রেণিতে এবং সবার ছোট সুমন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।সেলিম ইসলাম অনিক বলেন, আমি আগে দেখতে পেতাম। আমার বয়স যখন আট বছর তখন আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন রাতে ঘুমাতে যাই। সকালে উঠে আবিষ্কার করলাম আমি আর চোখে দেখতে পাচ্ছি না। বাবা আমাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁরা (চিকিৎসকরা) জানালেন টাইফয়েডে আমার দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। এটা আর ভালো হবে না। এর দেড় থেকে দুই বছর পর আমার ছোট ভাই রাইসুল একইভাবে অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হওয়ার পর বাবা-মা আমাদের সবসময় উৎসাহ দিতেন। তাই আজও আমরা লেখাপড়া করে এগিয়ে যাচ্ছি।
রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, আমরা দুই ভাই একইভাবে অন্ধ হয়ে যাই। আমাদের লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। বাবা স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষকের মাধ্যমে জানতে পেরে আমাদের পঞ্চগড় সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই আমরা লেখাপড়া করে যাচ্ছি। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় আমরা দুই ভাই জিপিএ-৫ পেয়েছি।
আসাদ আরো বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। এখন আমার একটাই স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তবে এখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার বাবার পক্ষে আমাদের লেখাপড়ার খরচ জোগানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমরা চার ভাই-বোন একসঙ্গে লেখাপড়া করছি।
সেলিম ও রাইসুলের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার দুই সন্তান একইভাবে অন্ধ হয়ে যায়। আমি বিভিন্ন জায়গায় ভালো ডাক্তার দেখাই। কিন্তু তাঁরা জানিয়ে দেন ওদের চোখ আর ভালো হবে না। এরপর বাড়িতে এনে আমি ওদের পঞ্চগড়ে সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যালয়ে ভর্তি করে দেই। আমার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সন্তানরা লেখাপড়ায় ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে। গর্বে আমার বুকটা ভরে গেছে। কিন্তু এখন ওদের উচ্চ শিক্ষার খরচ আমি কোথা থেকে দেব ভেবে পাচ্ছি না।মা সেলিনা বেগম বলেন, আমার সন্তানরা অন্ধ হয়ে গেলে মানুষ অনেক কটুক্তি করতো, হাসাহাসি করতো। আমি কষ্টে বাড়ির বাইরে যেতাম না। তখন থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নেই আমার সন্তানদের আমি লেখাপড়া করাবো। যাতে ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদের দেখিয়ে দিতে পারি যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা এখন আর সমাজের বোঝা নয়। আমার মতো অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মায়েরাও যেন তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাতে উৎসাহ পায়।ছোট বোন সিমলা আক্তার বলে, আমার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাইয়েরা আমাকে লেখাপড়ার জন্য সব সময় উৎসাহ দেন। আমি আমার ভাইদের নিয়ে গর্বিত।স্থানীয় অধিবাসী নাজমুল ইসলাম বলেন, সেলিম ও রাইসুল আমাদের এলাকার গর্ব। অন্ধ হয়েও তারা থেমে থাকেনি। লেখাপড়া করে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পরিবারের পক্ষে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সহজ হতো।
পঞ্চগড় জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আল মামুন বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রদক্ষেপ নিয়েছে। তারা এখন লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তারা যে এখন আর সমাজের বোঝা নয় তার উদাহরণ সেলিম ও রাইসুল। তারা ভালো ফল করে লেখাপড়ার এক এক ধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের সফলতা কামনা করছি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অবজ্ঞা নয় একটু ভালোবাসা ও সহানুভূতি পেলে তারাও পরিণত হবে দেশের সম্পদে।