সতীর্থ রহমান :-
বসন্তের এক সুন্দর সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। প্রকৃতিতে হালকা শীতের আমেজ। ফাগুনের দখিনা বাতাসে মন ভরে যায়। মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার শুভলগ্নে অগ্নিঝরা মার্চের ৪ তারিখে দিনাজপুর পিটিআইয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের প্রথম শিফটের ডিপিএড প্রশিক্ষণার্থীদের শিক্ষা সফর অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা সফরের স্থান নির্ধারণ করা হয় দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া ও বাংলাবান্দা জিরোপয়েন্ট। শিক্ষা সফরে জনপ্রতি চাঁদা ধরা হয় এক হাজার টাকা। সকাল সোয়া আটটায় আমরা শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ডিপিএড প্রশিক্ষণার্থী, পিটিআই সুপার, ইন্সট্রাক্টর, স্টাফ ও পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিভাবকসহ প্রায় ২০০জন শিক্ষা সফরে অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষা সফরে নেতৃত্ব দেন ইন্সট্রাক্টর ফণী ভূষণ রায়।
শিক্ষা সফরের জন্য তৃপ্তি পরিবহনের চারটি বাস ভাড়া করা হয়। শিক্ষা সফরের পূর্বে পিটিআই মেইন গেটে দোয়া দরুদ পাঠ ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্ধারিত বাসে আসন গ্রহণ করার পর প্রত্যেককে একটি করে সাদা ক্যাপ প্রদান করা হয়। ক্যাপের সামনে লেখা ছিল ‘শিক্ষা সফর-২০২০, ১ম শিফট, পিটিআই, দিনাজপুর’। সঙ্গীতের তালে মাঝারি গতিতে বাস ছুটে চলছে দার্জিলিং বিশ্বরোড দিয়ে। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন অফিস, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও গাছপালার দৃশ্য এক নতুন আবেশ সৃষ্টি করে। বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর সবাইকে নাস্তার প্যাকেট ও পানির বোতল দেওয়া হয়। নাস্তার প্যাকেটে ছিল স্যান্ডউইচ, কলা, কমলা, লাড্ডু ও প্রাণের হট টমেটো সচ। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে স্যান্ডউইচে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। টক ও দুর্গন্ধের কারণে অনেকেই স্যান্ডউইচ খেতে পারেনি। চলন্ত বাসে নেচে গেয়ে হাততালি দিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন জিপিএড প্রশিক্ষণার্থীরা।
বাংলাদেশের মানচিত্রের উপরিভাগে অর্থাৎ একদম শীর্ষে পাখির ঠোঁটের মতো যে স্থানটি রয়েছে সেটিই হচ্ছে দেশের সর্বোত্তরের স্থান তেঁতুলিয়া। এখানেই রয়েছে জিরোপয়েন্ট। আর এ জিরো পয়েন্টের অবস্থান হচ্ছে তেঁতুলিয়ার এক নম্বর বাংলাবান্দা ইউনিয়নে। বাংলাবান্দা হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান স্থলবন্দর। যার তিন দিকেই রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত। বলা হয় পঞ্চগড়ের এ তেঁতুলিয়া থেকেই বাংলাদেশের সীমানা শুরু। জাতীয় সংসদের ১নং সংসদীয় আসনটির শুরু হয়েছে এখান থেকে। পঞ্চগড় জেলার ব্রান্ডিং শ্লোগান হচ্ছে ‘উত্তরের প্রবেশ দ্বার, সবুজ চায়ের সমাহার’। বেলা সোয়া এগারোটায় আমরা তেঁতুলিয়া পিকনিক স্পটে পৌঁছি। বাস থেকে নেমে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ও এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখি। তেঁতুলিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা নদী। নদীর ওপারে আছে ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। নদীতে দলবেঁধে পাথর শ্রমিকরা ছোট বড় বিভিন্ন আকারের পাথর উত্তোলন করছে। স্থানীয় লোকজন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাথর তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটায়। বাংলাদেশের মানচিত্রের শীর্ষে অবস্থিত উত্তর দুয়ারী বলে খ্যাত পঞ্চগড়ের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত উপজেলা তেঁতুলিয়া। তেঁতুলিয়াকে বলা হয় মুক্তাঞ্চল। স্বাধীনতার তীর্থভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে চারটি এলাকা মুক্তাঞ্চল ছিল তার মধ্যে তেঁতুলিয়া অন্যতম। কারণ অন্যান্য স্থানে কিছু সময়ের জন্য শত্রুপক্ষ প্রবেশ করতে পারলেও এক মুহুর্তের জন্যও হানাদার বাহিনী তেঁতুলিয়ার কোথাও পা রাখতে পারেনি। তাই একে বলা হয় মুক্তাঞ্চল। তেঁতুলিয়ায় রয়েছে প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন একটি ডাকবাংলো। যেটি নির্মাণ করেছিলেন কুচবিহারের রাজা। এর মূল কাঠামো অনেকটা মোগল সম্রাট শেরশাহের আমলের সরাইখানার মতো। বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমানা রেখার মধ্যে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু টিলার ওপর এটি নির্মিত। তেঁতুলিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সমতল ভূমিতে চা উৎপাদন। দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়ে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন এবং বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সদরে এসে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেন। সেই থেকেই শুরু। অতঃপর সেই সময়ের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল ইসলামের তত্ত¡াবধানে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে টবে, পরে জমিতে চা চাষ করা হয়।২০০০ সালে সর্বপ্রথম তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড এবং কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। তবে সম্পূর্ণ সমতলভূমিতে ভিন্ন আদলে বাংলাদেশের প্রথম ও শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত অরগানিক চা বাগানের যাত্রা শুরু করেন কাজী অ্যান্ড কাজীটি এস্টেট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক কাজী শাহেদ আহমেদ। তার প্রতিষ্ঠিত কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিঃ বিশ্ববাজারে তেঁতুলিয়া অরগানিক টি নামে পরিচিত। যার নামকরণ করা হয়েছে তেঁতুলিয়ার নামে। বিভিন্ন ধরন এবং ফ্লেভারের চা পাওয়া যায় এখানে। যা বিশ্ববাজারে সমাদৃত। সে সময় ১ লাখ গাছ লাগিয়েছেন, ঝরেপড়া শুকনো পাতার জন্য। সে গাছ এখন ৭ লাখের বেশি হয়েছে। এভাবেই হাজার হাজার বিঘা সমতল ভূমিতে অরগানিক চা গাছের চাষ করে বাংলাদেশের চায়ের বিশ্ববাজার তৈরিতে অবদান রেখেছেন। প্রতিবছর এখানে ৫ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়। যা স্থানীয় চা প্রেমিকদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। উল্লেখ্য এ এলাকার প্রান্তিক চাষিরাও আস্তে আস্তে তাদের খন্ড খন্ড জমিতে চা চাষ শুরু করেন। প্রতিবছর জমি চাষ ও রোপণের ঝামেলা না থাকায় অনেকেই বাড়ির আশেপাশে উঁচু পতিত জমিতে শাক সবজির বদলে চা চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। এক বছর চা গাছ লাগালেই ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে ফলন পাওয়া যায়। চা চাষের ফলে এখানে ১০/১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তেঁতুলিয়া থেকে হেমন্ত ও শীতকালে উপভোগ করা যায় কাঞ্চনঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
দুপুর সাড়ে বারোটায় বাসযোগে আমরা তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্দা যাই। তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্দার দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। বাংলাবান্দা স্থলবন্দর এক নজর দেখে আমরা জিরো পয়েন্টের কাছে যাই। এটি সংরক্ষিত এলাকা এবং বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত। বিজিবি সদস্যের সাথে কথা বলে আমরা জিরোপয়েন্টে যাই এবং সেখানে গ্রুপ ছবি তুলি। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাবান্দা দেশের একমাত্র স্থলবন্দর, যেখান থেকে চারটি দেশের অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ও ভুটানের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদানের সুবিধা রয়েছে। প্রায় ১০ একর জমিতে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় এ বন্দর। এই বাংলাবান্দা জিরোপয়েন্টে সপ্তাহের ৬ দিন বিকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দুই দেশের সীমান্তবর্তী বাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজিবি ও ভারতের বিএসএফ সদস্যদের অংশ গ্রহণে জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনি অর্থাৎ একটি যৌথ বিরতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের যৌথভাবে কুচকাওয়াজ এবং করমর্দনের মাধ্যমে এ্ই অনুষ্ঠানে একসঙ্গে পতাকা নামানো হয়। দুই দেশের সীমান্তে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যই মূলত এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। (তথ্যসূত্র: মানচিত্রের শীর্ষে ইত্যাদি: হানিফ সংকেত।দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)।
সময়াভাবে রিট্রিট সেরিমনি দেখার সুযোগ না পাওয়ার কারণে খুব খারাপ লাগে। বাংলাবান্দা ঘুরে ফিরে দুপুর দুইটার দিকে আমরা কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটে যাই। অনুমোদন না থাকার কারণে আমরা কাজী টি এস্টেটের ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনি। এখানকার বিশাল চা বাগান দেখে মনপ্রাণ ভরে যায়। ছোট ছোট সবুজ চা গাছগুলো ছবির মতো দেখায়। এখানকার মিনি মীনা বাজারে অনেকেই কেনাকাটা করেন। আমি পরিবারের সদস্যদের জন্য অরগানিক মিষ্টি ও গ্রিন টি ক্রয় করি।
দুপুর গড়িয়ে সাড়ে তিনটার দিকে খেতে বসি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছিল। ডাকবাংলোর ডাইনিং রূমে তিন ধাপে খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলে। পোলাওয়ের সঙ্গে মুরগির রোস্ট, খাসির মাংস, ডিম, বুটের ডাল, শশা ও গাজর পরিবেশন করা হয়। খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রামের জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়। এসময় শিক্ষক প্রশিক্ষণার্থীরা কেনাকাটা ও আশেপাশের দর্শনীর স্থান দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দলবেঁধে ভ্যান ভাড়া করে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের বাঁশঝাড় দেখতে যাই। বাঁশঝাড়ে নেপালি হলুদ বাঁশ এবং সুইচ্চ লম্বা মোটা বাঁশ দেখে খুব ভালো লাগে। অনেকেই বাঁশের ছবি তোলে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই বাঁশকে বোম্বাই বাঁশ বলে থাকেন। তেঁতুলিয়া পিকনিক স্পটে ভ্যানে করে একজন লোক চায়ের চারা বিক্রি করছিল। প্রতিটি চারার মূল্য ত্রিশ টাকা। অনেকেই চা গাছের চারা ক্রয় করেন। আমি তেরোটি চা চারা ক্রয় করে আমার বাগানে পরম যত্নে রোপণ করি।
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো চত্বরে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। মহিলাদের জন্য সঙ্গীতের তালে বালিশ বদল এবং পুরুষদের বল নিক্ষেপ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। বালিশ বদল খেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন রাবেয়া বেগম এবং বল নিক্ষেপে প্রথম হন কামাল হোসেন। শিক্ষা সফরের আকর্ষণীর পর্ব ছিল র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠান। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ২০ টাকা। র্যাফেল ড্র বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন ইন্সট্রাক্টর জনি দস। র্যাফেল ড্রয়ের প্রথম পুরষ্কার একটি স্মার্ট ফোন জিতে নেন ডিপিএড প্রশিক্ষণার্থী আরজুনা খাতুন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের আধার নেমে এলে শিক্ষা সফরের সমাপ্তি ঘটে। সন্ধ্যা সাতটায় তেঁতুলিয়া থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। ঘুম ঘুম চোখে ক্লান্ত শরীরে পিটিআইতে পৌঁছতে রাত পৌনে দশটা বেজে যায়।
পরিচিতি: সহকারী শিক্ষক, নুনসাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রতিনাথপুর, মুরাদপুর, সদর, দিনাজপুর।