আজহারুল আজাদ জুয়েল॥
১৫ জুন মি. জর্জ দাশ এর মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে মহাপ্রয়াণে চলে গেছেন দিনাজপুরের প্রখ্যাত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্পুর্ণ অবদানের কথা দিনাজপুরবাসীর সাথে সাথে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষেরও অজানা নয়।
জর্জ ভাই নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। অথচ দূর্ভাগ্য যে, আমরা এখন জর্জ ভাইকে ভুলতে বসেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন দিবসে, অ-দিবসে কত আলোচনা হয় কিন্তু জর্জ ভাইয়ের নাম কেউ মুখেও তোলেন না!
দিনাজপুরে জর্জ দাসের নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনী পরিচিতি পেয়েছিল ‘জর্জ বাহিনী’ নামে। তাদের দু:সাহসিকতার কারনে পাকিস্তানি বাহিনী সর্বদা তটস্থ থাকত। রামসাগর, ঘুঘুডাঙ্গা, মোহনপুর, বিরল সহ বিভিন্ন এলাকার অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের অনেকের প্রাণ যাওয়ায় জর্জ বাহিনী নামটা বেশি করে ছড়িয়েছিল। জর্জ বাহিনীর কারণে পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে আতংক এমনভাবে বিরাজ করছিল যে, তারা যখন তখন ম্যুভ করার সাহস হারিয়ে ফেলেছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মি. জর্জ দাস
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু জর্জ দাস সারা জীবন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের পর যে বিছানায় ঘুমাতেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালের ব্যবহৃত একটি কম্বল বিছিয়ে রাখতেন। কম্বলটির অতি ব্যবহারের ফলে ব্যবহারের অনুপযোগি হয়ে গিয়েছিল। একবার কম্বলটির অংশ বিশেষ পুড়েও গিয়েছিল। এরপরেও এটাকেই তিনি তার বিছানায় বিছিয়ে রাখতেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক হিসেবে। মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত এই স্মারক সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়েছেন মি. জর্জ দাস।
যার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালবাসা মুক্তিযুদ্ধ, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবনের বেশির ভাগ সময় অভাব-অনটনে জর্জরিত ছিলেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থ্যতায় ভুগে মারা গিয়েছিলেন অনেকটা বিনা চিকিৎসায়। সান্তনা এটাই যে, অন্য কিছু না পেলেও মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিলেন। জাতীয় পতাকায় কিছুক্ষণ ঢেকে রাখা হয়েছিল তার লাশ। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল বিউগলের করুণ সুরে। তাঁর শেষ যাত্রায় আমি নিজেও লেখক) অংশ নিয়েছিলাম। খৃষ্টীয় সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তির শেষকৃত্যতে আমার প্রথম অংশগ্রহণ ছিল এটা।
দিনাজপুর জেলা শহরের মিশন রোড নিবাসী জর্জ দাস মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সৈনিক ছিলেন। এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে। উনসত্তুরের (১৯৬৯) গণঅভুত্থানের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাঙালি সৈনিকদের বিরুদ্ধে অঘোষিত পদক্ষেপ নেয়া শুরু করলে সাহসী সৈনিক জর্জ দাসের ভাগ্যেও বিপর্যয় নেমে আসে। ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। একজন চাকুরীজীবী হিসেবে এটা অবমাননাকর। তবে এই বাধ্যতামুলক অবসর এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছিল তাঁর জন্য। মুক্তিযুদ্ধে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাতে পেরেছিলেন তার এই নতুন জীবনকে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরেও তৎকালিন শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে শ্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর ডাক দিয়েছেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে দেশের মানুষ। বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ডামি রাইফেলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দিনাজপুর এর ব্যতিক্রম থাকতে পারেনা। বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘তোমাদের যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর’ বলার পর দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে যুবকদের মধ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রবনতা বেড়েছে। প্রশিক্ষণ চলছে বিভিন্ন স্থানে। অন্যতম প্রশিক্ষক জর্জ দাশ। তিনি কেবিএম কলেজে ডামি রাইফেলের সহায়তায় যুবকদের সামরিক ট্রেনিং দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দিনাজপুরের বীর জনতা পাকিস্তানি সেনাদের অন্যতম ঘাঁটি ইপিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টার কুঠিবাড়ি দখল করে নেয়। এই দখলদারিত্বে জর্জদাস তার স্বেচ্ছা সেবকদের নিয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কুঠিবাড়ি দখলের পর দিনাজপুর শহর থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। এর ফলে জেলা সদর মুক্তাঞ্চলে পরিনত হয়।
এর ক’দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী আবারো সৈয়দপুর হতে দিনাজপুর শহরের দিকে অগ্রাভিযান শুরু করলে জর্জ দাস কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে প্রথমে ভূষিরবন্দর, পরে দশমাইলে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। একই সময়ে আরো কয়েক হাজার মানুষ পাকিস্তানিদের অগ্রাভিযানে বাধা দেয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু শত্রু বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দিনাজপুর শহর আবারো হানাদারদের দখলে চলে যায়। এমতাবস্থায় অন্য অনেকের মত ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন জর্জ দাস। সীমান্ত সংলগ্ন হামজাপুর-শিবপুর এলাকায় মুক্তিকামী যুবকদের সংগঠিত করেন তিনি। সেখানে ৪ শ’ যুবকের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গড়ে তোলেন। এই দল পরে মুজিব নগর সরকারের ৭নং সেক্টরের আওতায় কার্যক্রম শুরু করে এবং ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ ভাবে জর্জ বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। কাগজে-কলমে জর্জ বাহিনী না থাকলেও জর্জ দাশের নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর দুঃস্বাহসিক অভিযানে পাকিস্তানি হানাদারদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়, যা যুদ্ধকালিন পরিস্থিতিতে বাঙালিদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে অবদান রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা, লুকিয়ে রাখা অস্ত্র উদ্ধারেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০০ সালে দিশারী ফাউন্ডেশন-ঢাকা কর্তৃক ‘দিশারী সম্মাননা’ এবং ২০০৮ সালে দৈনিক তিস্তা কর্তৃক ‘তিস্তা পদক’ লাভ করেছিলেন এই অকুতোভয় সৈনিক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণরত বীর মুক্তিযোদ্ধা মি জর্জ দাশ।
দিশারী ফাউন্ডেশন কর্তৃক সম্মাননা দেয়ার সময় জর্জ দাসকে একটি স্মারক পত্র দেয়া হেেয়ছিল। ফাউন্ডেশন সভাপতি সুধীর অধিকারী স্বাক্ষরিত ঐ স্মারক পত্রে জর্জ দাস সম্পর্কে যে মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছিল তা পাঠকদের জানার স্বার্থে তুলে ধরা ধরা হলো;
‘মুক্তিযোদ্ধা জর্জ দাস দেশের গৌরব, খৃষ্টান সমাজের গর্ব। তাঁর দেশপ্রেম ও সাহসিকতা নবপ্রজন্মের কাছে একটি অনুপ্রেরণা। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের সেই উদাত্ত আহ্বানে মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য সবকিছু ছেড়ে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জর্জ দাস। দিনাজপুর শহরের অধিবাসী জর্জ দাস তদানীন্তন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস এ চাকুরী করতেন। দক্ষ সেনাপতির মত অতি দ্রুত একটি যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তি বাহিনী ইউনিট গড়ে তোলেন। প্রশিক্ষণ দেয়া বাহিনী ৭ নম্বর সেক্টরের, ৪ নং উপ সেক্টর হামজাপুর-শিববাড়ি এলাকায় জর্জ বাহিনী নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। অসম সাহসী ও ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা মি. জর্জ দাশ তার বাহিনী নিয়ে ৪ নম্বর উপ সেক্টরে, হামজাপুর-শিববাড়ি মূল মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটে যোগ দেন ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। যে দীর্ঘ ৯ মাস মরণপণ রক্তযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তিনি তার পূর্ণ অংশীদার। দখলদার বাহিনী কর্তৃক পুঁতে রাখা হাজার হাজার স্থল মাইন অপসারণের বিপদপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি তাঁকে নিতে হয়। অসীম ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে দিনের পর দিন, তিনি স্থল মাইন অপসারণের কাজ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজ সেবক মি. জর্জ দাশ খ্রীষ্টান সমাজের তথা দেশের একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ গোটা খ্রীষ্টান সমাজকে গৌরবাম্বিত করেছে। দিশারী ফাউন্ডেশন মি. জর্জ দাশকে দিশারী ঘোষণা করছে।’
সম্মান ও মর্যাদা অর্জিত হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা জর্জ দাশের অর্থনৈতিক অবস্থা কখনো ভাল ছিল না। অর্থ কষ্ট দূর করতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন। প্ল্যান ইন্টারন্যশনাল নামের একটি এনজিওর রানীরবন্দর ইউনিটে বছর কয়েক নাইট গার্ডের চাকুরীও করেছেন। তাঁর মৃত্যুর আগের থেকে সরকার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু করেছিলেন। মৃত্যুকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জর্জ দাশের মাসিক ভাতা ছিল ৯০০ টাকা। জর্জ দাশ মৃত্যুকালে স্ত্রী ডরথী ঝরনা রানী দাস, পুত্র সিমসন দাস, ৪ কন্যা রীনা, চন্দনা, সাথী ও সিমথিয়াকে রেখে যান। স্ত্রী ডরথী ঝরনা রানী দাস ২০১৬ সালে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, মাত্র ৭ বছর হলো জর্জ ভাই মারা গেছেন। এর মধ্যেই সবাই কেমন করে যেন তাঁকে ভুলে গেছে! এত প্রোগ্রাম হয় কিন্তু তাঁর নাম কেউ মুখে আনে না!
এ বছর জর্জ দাসের মৃত্যুর ১২ বছর হতে চলেছে। কিন্তু ২০১৬ সালে যে আক্ষেপ তার স্ত্রী করেছিলেন, তা এখনো তেমনিই রয়ে গেছে। জর্জ দাস একন অনেকটাই হারিয়ে গেচেন।
জর্জ দাস কোন সাধারন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের থেকে যুবকদের ট্রেনিং দিয়েছেন। নিজেই ক্যাম্প খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করেছেন। পরে মুজিব নগর সরকারের আওতায় তার বাহিনীকে সম্পৃক্ত করে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর মাত্র কয়েক বছরে তাঁকে মানুষ ভুলে যায় কেমন করে? সেই প্রশ্ন একজন লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক হিসেবে আমারো।
লেখক
আজহারুল আজাদ জুয়েল,
সাংবাদিক, কলামিষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক